Thursday, June 08, 2006

মোচ্ছব


মোচ্ছব
- কমলেশ পাল
 

আজ আমি খিচুড়ি খাব না ৷
প্রতিবারই ছ্যাড়ছ্যাড়ে খিচুড়ি খাওয়াও
শেষে পেট ভুট্‌ভাট্ করে ৷
 
আজ আমি রাস্তায় খাব না ৷
প্রতিবারই তাড়া দিয়ে রাস্তায় বসাও
কুকুরেরা পাতে মুখ দেয় ৷
 
আজ কলাপাতায় খাব না ৷
প্রতিবারই কাটাফাটা ছেঁড়া-পাতা দাও
চোখ বুঁজে নোংরা খেতে হয় ৷
 
যদি বল : নারায়ণ সেবা
তবে ঐ শালুমোড়া বেদীতে বসব
কাসাঁর থালায় আমি পরমান্ন খাব ৷
 
যদি বল : কাঙালী ভোজন
তবে এই ধম্মকম্ম মোচ্ছবের মুখে
লাথি মারি আমি ৷

চৌকিদার


চৌকিদার
- কমলেশ পাল
চিন্তা আমার রাতের চৌকিদার
ঘুমুতে দেয় না
সারারাত হাঁকে - হুঁশিয়ার ! হুঁশিয়ার !
*

অথচ ঘুমাব আমি
হাতের কাছেই আছে ক্যাম্পোসের বড়ি ৷
দরকারে একটি দুটি, দরকারে যতগুলি খুশি
গিললেই ডেকে নেবে অন্তহীন ঘুমের ঈশ্বরী ৷
এখন যা খুশি করা যায়
ইচ্ছে হলে মরা কিংবা ইচ্ছে হলে টিকে থাকা যায় ৷
মুহূর্তের ভীষ্ম আমি শুয়ে আছি শরের শয্যায় ৷
**

বাড়ির সবাই গেছে পূজার প্যাণ্ডেলে
বন্ধুবর্গ ধুনুচির নাচে
অথবা চুল্লুর ঠেকে, কেউ তিন-তাসে -
দিগন্ত প্লাবিত হচ্ছে মাইকের "জি লে লে" উচ্ছ্বাসে ৷
হবেই তো, আজ শ্যামাপূজা ৷
ইতিহাস পৃষ্ঠা থেকে হার্মাদ ডি-সুজা
রঘু কিংবা লম্বু পিপে ট্যারা
করালী রাত্রির পায়ে কষে দিচ্ছে শক্তির মহড়া -
এ পূজায় রক্ত চাই, মহাশঙ্খে আগ্নেয় কারণ ৷
শুনেছি, সেকালে নাকি নরবলি হোতো?
হোতো কি, এখনো হয় ৷ অতি সূক্ষ্ম মিহিন খর্পরে
কাটার পরেও মুণ্ড যথাযথ লেগে থাকে ঘাড়ে ৷
মুণ্ড যদি খেতে বসে, অফিসে দৌড়ায় কাটা ধড়;
ভিতরে ফিনকি দেয় রক্তের স্বাক্ষর;
শরীরের কোষে কোষে মৃত্যুর আক্ষেপ
থত্থর থত্থর কাঁপে, বাইরে স্বাভাবিক ৷
খোশগল্পে যেমন আমিও হাসিতে ঠাট্টায় আছি
কেরানি বাজারে মাছি বাসী-ফাইলে, পচা ডিসিপ্লিনে
সারাদিন ভন্ভন্ - সাহেবের থাপ্পড় এড়িয়ে
বাসে ট্রামে ভিড়েঠাসা ঝুলন্ত লোকালে
ভুলে কেউ পা-টুকু মাড়ালে বিশাল চক্কর তুলি
বিষহীন লাঞ্চিত লেজের ব্যবহারে ৷
***

অথচ সন্ধ্যার মুখে খুলেছিল হাসি -
যে হাসি মহার্ঘ খুব আমাদের দৈনিক জীবনে ৷
অত্যন্ত গোমড়ামুখো বাড়িরও কার্নিসে
বসেছিল হাসিখুশি প্রদীপের মেলা,
আতসবাজির খেলা, ফুলঝুরি তুবড়ি হাউই -
হুই .... হুই .... মল্লিকবাড়ির ছাদ ডিঙিয়ে পেরোচ্ছে
দুখুর উড়ন্ত সাধ, যে বেচে বাদাম৷
আজ সেও সত্যকাম, অন্তত সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ ৷
এক থেকে বহু হতে ঈশ্বর যেমন
এক শিখা সহস্র শিখায়
ঘরে মোম মেতেছিল আনন্দ খেলায় ৷
খেলা কি কেবল ঘরে?
খেলা চলে অসীম চত্তরে -
উপবৃত্ত গ্রহ-তারা সৃষ্টির শিশুরা
কালের কহ্লারে মগ্ন প্রজাপতি ঘিরে
অবিশ্রাম ঘুরে ঘুরে কানামাছি খেলে ৷
অথবা, লণ্ঠন জ্বেলে আলপথে যেন ফেরে গ্রামের বাড়িতে -
যেমন বোনাস পেয়ে কেউ কেউ পুজোর ক'দিন
মহানন্দে হিল্লিদিল্লি ঘুরে
ডোমজুড়ে, বালিচকে ফিরে আসি ছুটিশূন্য ফতুর পকেটে ৷
আমিও, হে অমারাত্রি, ঘুমঘরে ফিরে যেতে চাই ৷
***

তবু এই চতুর্দিকে শব্দমান পটকা দোদমা
তারই মাঝে দুটি একটি ছদ্মবেশী আকস্মিক বোমা
ঘুমের পয়ার ভাঙে৷ ছন্দে এসো সোমা -
এ বিকট শব্দে খুবই ভয় তুমি পেতে;
সদর রাস্তার ভিড়ে হেঁটে যেতে যেতে
অকস্মাত্ ডানা মেলে আমাকে জড়াতে ৷
সবটুকু ভয় নয়, কিছু ছিল সুন্দর ভেজাল,
যেভাবে সরিষা তেলে অপূর্ব মিশাল
শিয়লকাঁটার বীজ ৷
সোমা, তুমি শিকারী মাতাল
তির্যক নিশানা জানো ৷ সিংহের আহার
দুথাবা মাংসের টোপ রেখেছিলে অরণ্যে আমার ৷
আমি তো এলাম ফিরে ঘ্রাণ শুঁকে শুধু একবার ৷
পাড়ার সবাই জানে, আমাদের পুরনো সম্পর্ক গেছে চুকে ৷
ঠোঁটের রঞ্জক লেগে রক্তরেখা রয়ে গেল পাঞ্জাবির বুকে ৷
****

শুধুই কি সোমা নাকি? আরো, আরো কত
অদৃশ্য বুকের দাগগুলি
বিস্মৃতি সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে তুলি ৷
আমার মায়ের মুখ তুলি প্রথমেই -
তাম্বুলে জারিত ওষ্ঠ, দীপ্ত চক্ষু, কাঁচাপাকা দীর্ঘ কেশদাম
লক্ষ্মীর পটের সামনে গলবস্ত্র ভূমিষ্ঠ প্রণাম
দুঃখের সংসারে শীতে চন্দ্রপুলি হাসি
- গাড়ির সময় হোলো, মাগো তবে আসি .....
- যাসনে ঈশানে দ্যাবা ডাকে
ঘন ঘন চিল্লায় চিক্কুর
আমারে একলা ফেলে যাবি অত দূর !
তবুও গেলাম চলে যেভাবে তোমার
হাতের সোনার চুড়ি, কানপাশা, হার
একে একে গিয়েছিল সংসারের হাঁ-মুখ বোজাতে -
আমারও তেমনি যাওয়া
স্নেহের চৌকাঠ টপকে ডোরাকাটা হিংস্র রাজপথে ৷
*****

লাল-নীল, লাল-নীল, সবুজ হলুদ
চৌরাস্তায় চোখ মারে চারদিকে আলোর ইশারা৷
ধর্মতলার মোড়ে সব পথ সমান প্রধান!
নিচু হয়ে যে করে সেলাম, আর
মাথা-উঁচু যে সটান হাঁটে;
যে খাটে উদয় অস্ত, যারা গাঁট কাটে -
স্ব স্ব ক্ষেত্রে সবাই প্রধান ৷
মানুষখেকোর সাথে তৃণভোজী সভ্য নাগরিক
বস্তুত সিনেমা দ্যাখে, রেস্তোরাঁয় রাজনীতি ফাটায় ৷
যদিও প্রখর তাপে পিচ গলে গ্রীষ্মের দুপুরে;
কামুক চাকার দাঁতে পিষে যায় বেকারের বিধ্বস্ত হাওয়াই ৷
এবং বুধনরাম রিক্সা নিয়ে প্রাণান্ত দৌড়ায় -
তবুও শীতল কক্ষে জিঞ্জার বিয়ার
আইসক্রিম, গোল্ডস্পট, কচি ডাব, লস্যি পাওয়া যায় ৷
যারা তা পায় না, তারা তে-ইট উনুনে
শিয়ালদায় ভাত রাঁধে, ভিক্ষা করে, রাতে দেহ বেচে ৷
"আমরা তৃতীয় বিশ্বে নিরপেক্ষ সমৃদ্ধ স্বাধীন ৷" -
চতুর মুখোশলি যখন বহরে কথা বলে
চাপ-চাপ রক্ত মেখে কৃষ্ঞচূড়া জ্বলে ৷
******

জ্বলে কি? অথবা সবই দৃষ্টির বিভ্রম?
"ও চোখে চলবে না আর, পাওয়ার পাল্টান" -
বলেছিল সত্তরের দশকে ধীমান,
দীনেশবাবুর ছেলে, কচি মুখ, ধারালো সরল ৷
"সমস্ত শক্তির উত্স বন্দুকের নল ৷"
তার এ মুখস্থ যুক্তি বার বার ভ্রান্ত বলে দিয়েছি সরিয়ে ৷
তবু সে কালিমা রাত্রে ফিরে আসে রক্তজবা নিয়ে ৷
কেন আসে? কে তাকে ফেরার জন্য দোহাই দিয়েছে?
স্মৃতি তো অনেক গেল ধুয়ে
কারো বা মগজ থেকে মিটে গেছে বিপ্লবের ঘোর ৷
ধীমানের হৃ‌ৎ‌পিণ্ড গরম সীসায় কিন্তু হয়েছিল এফোঁড়-ওফোঁড় !
বিস্ফোরক শক্তি কিছু বন্দুকের নলে
অসম শ্রেণীর দ্বন্দ্বে সত্যি সত্যি ছিল -
মরে সে প্রমাণ করে গেল ৷
********

থামো চৌকিদার ৷
সে সব উত্তপ্ত দিন মধ্যরাতে জাগিয়ো না আর
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ৷
বরং জমিয়ে বসে গল্প হোক উড়ন্ত চাকির ৷
সেই যারা জ্যোত্স্নায় নি:শব্দে নামে সুনশান মাঠের শিয়রে;
কাচের মতন স্বচ্ছ মানুষেরা এসে
পৃথিবী জরিপ করে মিশে যায় ভোরের বাতাসে৷
অথবা সাগর কন্যা - নিম্নাঙ্গ মাছের
ঊর্ধ অঙ্গ খোলামেলা সোমত্ত নারীর !
(নারী অর্থে খেঁদি পেঁচি কালিদাসী নয় ৷
নারী মানে গ্রেটাগার্বো, মেরেলিন, ইত্যাকার সিনেমা সুন্দরী)
প্রবাল প্রাচীরে তারা গা এলিয়ে দিয়ে
নাবিক-পাগল-করা গান গায়
টুংটাং ঝিনুকের মন্দিরা বাজিয়ে ৷
বিশ্বাস হোলো না বুঝি? মনে মনে তাও
বিশ্বাসের চেষ্টা করে যাও,
স্নায়ু শান্ত হবে ৷
স্নায়ু যদি শান্ত হয়, ঘুম হবে নাকি?
ঘুমেরও ভিতরে আমি বস্তুময় স্বপ্নে জেগে থাকি ৷
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বস্তুময় ৷
বস্তুর অদৃশ্য কণা সূক্ষ্ম লেগে রয়
বস্তু থেকে উত্সারিত আমাদের স্বপ্নে চেতনায় -
যেমন ফুলের গন্ধে ফুলের নির্যাস
বাতসে সাঁতার কেটে অপরূপ ঢেউ তুলে তুলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে আনন্দ জাগায়,
স্নায়ুর স্পন্দনে জাগে মন -
মুদ্রিত কলির মধ্যে
স্বপ্ন এক স্তব্ধ জাগরণ ৷
রাতের মাস্তুলে বসা ডানামোড়া এল্‌বাট্রস পাখির মতন
ধূপ জ্বেলে সেতারে আঙুল রেখে চুপ বসে থাকা -
যা হতে পারিনি আমি, যে পরম পাওয়া -
যে আকাশ ছোঁয়া আজও বাকি রয়ে গেল,
তাই হওয়া, তাই পাওয়া -
সমস্ত ভাণ্ডার ছুঁতে চাওয়া ৷
********

হয়তো আমার চাওয়া প্রাচুর্যে ভূমায় ৷
একটি চুমায়
আমি পেতে চাই
জন্ম থেকে মৃত্যুব্যাপী
জীবনের সম্পূর্ণ আস্বাদ ৷
পৃথিবীর যাবতীয় লোহার গরাদ
ভেঙেচুরে গুঁড়ো হয়ে উড়ে যাক
মিলনের দামাল বাতাসে ৷
পাসপোর্ট ভিসা ছিঁড়ে খুলে যাক
সমস্ত সীমানা ৷
জানি, সেটা সহজে হবে না ৷
তবু, যারা অল্পে তৃপ্ত - মধুপর্ক বাটি দুফোঁটার -
ভাতে নুন লঙ্কা পেলে যারা বর্তে যায়
ফকরুর আব্বার মতো
দুকাঠার ডোবা কেটে দশগণ্ডা তেলাপিয়া ছেড়ে
ভেড়ির কর্তার মতো দাড়িতে সে আঙুল চালায় ৷
ভাসমান ছিপছিপে কলমির নিচে
স্বপ্নের মাছেরা খ্যালে,
উপরে মাচায় বর্ধমান লাউডগা, পুঁইলতা -
সন্ধ্যেবেলা ফোটে ঝিঙাফুল ......
বিলকুল মোক্তার অজ্ঞ, বিবি তার এ-বেলা উপোসী,
তিনতলা চাষ নিয়ে দুকাঠায় সে দারুণ খুশি ৷
ছোটো সে খুশির মধ্যে কোন্ ফাঁকে ঢুকে এক ঢোঁড়া
চোয়ালে মাছের চারা নিয়ে কাটে সোনালী সাঁতার ৷
হঠাত্ দেখতে পেয়ে চিল্লায় মোক্তার :
"ঐ শালা মোনসার পুত
রোজ মোর পোনা খেয়ি যায় -
ফকরু ! বারান্দা থেকি সাতনালা কোচটা নে' আয় ৷"
তখন ঢোঁড়াটি কয় দুহস্ত জুড়িয়া :
"তোমার তো বড়ো গোসা মিয়া !
মেরো না খেয়েছি পোনা, স্বীকার কসুর ৷
তোমার সংসার খায় বেনিয়া গোক্ষুর !!"
*********

এ তো দেখি কিস্সা হয়ে গেল ৷
তুমি জানো, সাপ তাকে কিছুই বলেনি;
চালাচ্ছো নিজের কথা, নাম দিয়ে ঢোঁড়ার জবানি ৷
রূপকে শব্দের প্যাঁচে এতক্ষণ গেলে শুধু খেলে -
পড়নি এখনও ধন, পণ্ডিতের মেলে ৷
সত্যই পালিয়ে ফিরি পণ্ডিতের ভয়ে ৷
দিকে দিকে সভাকক্ষে, বিশ্ববিদ্যালয়ে
যেখানেই যাই, দেখি, তালধ্বজ বিজ্ঞপ্রবরেরা
কূটতর্কে মেতে আছে হেতু - হেত্বাভাসে;
ছাত্রেরা ব্যায়ামে ব্যস্ত থিসিসের কঠিন প্রয়াসে !
আমি মূর্খ যাই কোন দিকে?
হাতে পেলে পাঁচ সিকে
কফি হাউসে পাঁচ ঘন্টা আড্ডা মারা যেত;
দিলীপ-শৌনক-রাম-মলয়কে নিয়ে
কবিতা কীর্তনে কিছু সিগারেট ধ্বংস করা যেত;
দ্বিজেনও এখানে নাই .......
পণ্ডিতের গন্ধ আসে - কুমারেশ ভৌমিকের দোকানে পালাই -
কথার শফরি আমি অল্প জলে সেখানে চমকাই ৷
এভাবে কর্তব্য মুড়ে খণ্ডে খণ্ড দীর্ঘ পলায়ন
পৌঁছে যেতে বোধিমূলে
গঞ্জিকা সেবন, ড্রাগ তুরীয় সমাধি;
মৃত্যু জরা ব্যাধি এড়াতে চোরের মতো
চুপিসাড়ে চেতনার প্রদীপে ফুত্কার ৷
জায়া-কন্যা-নন্দনের টান কেটে ছিঁড়ে
চাইবাসা থেকে আরো পশ্চিমে ভিতরে
কারো-নদী, কোয়েলের ধারে
পিয়ালের শ্যামল শালের আঙিনায়
নীল বড় চাঁদোয়ার নিচে চাঁদনীতে
আদিবাসী ঝুমুরের নাচের ধুলোটে
কষে খুব পলায়ন গেছে ৷
কত পাতা, কত ফুল টোপা-মহুলের,
কত যে শালের বীজ ঘুরে ঘুরে উড়ে গেছে চৈত্রী বাতাসে ......
পাইনি মুক্তির ঘ্রাণ ৷ সুজাতার ক্ষীরের পায়েস ছিল পড়ে শংকরের মায়ার সংসারে ৷
আবার ঘরেও ফিরে প্রাত্যহিক জীবন যাপনে
রয়ে গেল সেই ধুলো, ক্লান্ত সুর বিষণ্ন ঘুঘুর -
তিতির-তন্ময়-বনে গুটিগুটি পেরুনো দুপুর ৷
***********
"না রে না
ওটা কিন্তু দুপুর ছিল না ৷
গুটিগুটি পেরুচ্ছিল তোর আয়ু, বিশুদ্ধ সময় ৷"
রকের ইয়ার চাঁদু চক্রবর্তী কয় :
"এই সিদ্ধ আড্ডাসন ছেড়ে
শেষে কিনা চাইবাসা, কোয়েলের ধারে ৷
পাপ শুধু পূর্ণ নয়, হোলো তোর এক পোয়া বেশি ৷
এ দোষ খণ্ডাতে হলে এক কাজ কর্ -
কর্মফলরূপী একটি তুচ্ছ সিগারেট
আমাতে অর্পণ করে মুক্ত হয়ে যা ৷
"গুরু বল্ মন্ত্রী বল্, শিল্পপতি বল্
সবাই আমার জাত - চক্রবর্তী ৷ তোরা হলি দাস ৷
খেটেছিস কেবল ফরমাস,
এতকাল কর্মফল আমাদেরই পাদপদ্মে দিয়ে এসেছিস
ভক্তিতে না হলে ভয়ে, শ্রীমুখের বাণীর বদলে ৷
আরো দিবি ৷ না হলে নিস্তার নেই,
ঝাণ্ডাপার্টি দেব রসাতলে ৷"
- দ্যাখ না পারিস কিনা - দন্তে আমি ধরেছি সংসার ৷
চেয়ে দ্যাখ চক্রবর্তী, আমিই তৃতীয় অবতার !
************

দেখেছিস বিশ্বরূপ? এই চাঁদু, এই চন্দ্রনাথ ! .....
আমার গর্বিত ডাক খেল শূন্য চেয়ারে হোঁচট ৷
তবে কি মশারি বন্দি এতক্ষণ আমি
ফাঁকা তর্ক চালালাম বিছানার সাথে?
পোশাকে পেশায় বন্ধু, আমি আর তোমাদের বাঞ্ছনীয় নই;
শ্মশান-যাত্রার খই, ধুলো খাই, কুকুরেই চাটে ৷
অথচ, সেদিন ডেকে বিকাশেন্দু আমাকেই তুলত গাড়িতে ৷
সে নয় আমার মতো ফালতু ফতুর ৷
গ্যারেজে টয়োটা পোষে, ঘরে পোষে বিলিতি কুকুর,
অফিসে দারুণ পি. এ পারমিতা রায়
ডমরু কোমর নিয়ে নিজে নাচে, তাকেও নাচায় ৷
আমি কি নাচব নাকি, সে যখন বলে :
"কী সুন্দর লেখ তুমি ভাই
তোমার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই ৷"
মিথ্যা কথা ! দালালি ফাটকাবাজি আর যা-ই করে
বিকাশেন্দু ওরা কোনো কবিতা পড়ে না ৷
কেন না, কবিতা এক ম্যাজিক আয়না
সামনে দাঁড়ালে তার ফুটে ওঠে প্রতিচ্ছবি অমল আত্মার -
আমি যা ধরতে গিয়ে ভাঙি চুরমার ৷
**************

প্রতিটি ভগ্নাংশ জুড়ি খুঁটেখুঁটে আমি ই আবার ৷
প্রচণ্ড ঝড়ের পর টুকিটাকি গুছোনোর মতো
সম্পূর্ণ দেখব বলে শুদ্ধ করে নিজেকে সাজাই ৷
অথচ, নিজের করে নিজেকেই সাজানো কঠিন ৷
মানুষের কোনো আত্ম-অবয়ব নেই৷
বর্ণে ধর্মে ভাষায় জাতিতে খণ্ডিতের কোনো পূর্ণ পরিচয় নেই ৷
খণ্ডিত বাংলায় আমি অংশত মানুষ ৷
খণ্ডে ভয় ৷ ডাক বাজে চামুণ্ডা-তলায় ৷
হাড়িকাঠ - শুদ্ধিমন্ত্র পাঠ করে পুরুতমশায় ৷
ছাগের প্রার্থণা আজ কেউ শুনবে না -
বলির জোকার দেয় সমবেত কলোনী-ললনা ৷
মুখে মুখে জিভ নড়ে, মুখে জিভ লক্‌লক্ করে,
নিচে শিব - জেগে থাকা মঙ্গল মৃত্তিকা ৷
আণবিক উন্মাদিনী, যতই না উলঙ্গ লাফাও
শিব যদি টলে যায়, তোমার অস্তিত্ব ডুবে যাবে ৷
************

নড়ে কি কখনও শিব? ভিতড়ে খড়ের
নির্বোধ কাঠামো নিয়ে কুমোরের পাইকারী ছাঁচে
গড়াপেটা ভরা মুখে, আঁকা ত্রিনয়নে
চিত্পাত মাটির ঢিবি পড়ে আছে শিব !
আবার মাটির শিব লাঙলের নিবিড় কর্ষণে
ঋতুর উত্সবে মেতে হয়ে যায় শ্যামা গর্ভবতী
মাটি বড় অদ্ভুত রঙ্গিনী!
কলাবতী ভাস্করনন্দিনী আমাকে প্রসব করে
ডানা জুড়ে উড়িয়ে দিয়েছে ৷
আমি তাই স্বপ্নে উড়ি কবিতায় উড়ি ৷
"মাটির বাড়িতে যাব, খোলা বোধ!" -
বাতাসে বাতাসে মাথা খুঁড়ি ৷
**************

জানো, চৌকিদার?
এক রাতে স্বপ্নে মা আমার খুলে দিল শূন্যের বাঁধন ৷
"বুকে আয় ৷ তুইও এই মাটির লবণ" -
বলে সে জড়াল বুকে,
মাটির বিপুল স্তন গুঁজে দিল মুখে ৷ সেই থেকে
ঘাম, রক্ত, অশ্রু, কফ, চোখের পিঁচুটি সমস্ত লবণময় ৷
ধুলোর চুম্বন চেখে দ্বিধাহীন বলি :
তোমার ব্যঞ্জনে মাগো লবণ অধিক ৷
লবণ! লবণ!
চোখের জলের ঢেউ - চারিদিকে লবণ লহর !
গর্জায় রক্তের ঢেউ - ছুটে আসে লবণ লহর !
দুঃখের সন্তান আমি, লবণের গর্বিত পুতুল
বঞ্চনা-সম্ভূত জাগি রক্তবীজ লবণ অসুর
স্বর্গ আমি কেড়ে এনে ভাগ করে দেব অভাজনে ৷
মৃত্যু, তুমি কী দেখাও ভয়?
আমি আছি মায়ের শরণে ৷
*************

মাথার ভিতরে নাচে ঘুমহীন এ কি পাগলামি?
এ কঠিন চক্রব্যূহে একা কী করতে পারি আমি?
নোটে, ভোটে, হরিবোলে, বন্দুকের নলে
যে যেমন সিদ্ধহস্ত, যেখনে যা চলে
সব আয়োজন নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে রথীগণ ৷
আমি পদাতিক - সত্তর শতাংশ রিক্ত
মানুষের একক প্রতীক -
আমারই ঘুমের জন্যে সব আয়োজন !
হে দেবী, সকল ভূতে নিদ্রার কারণ
ভিডিও পার্লারে ব্যপ্ত টিভি-রেডিওতে -
সংবাদ সংসদ তুমি, বিজ্ঞাপন তুমি
আমার হাতের কাছে হয়ে আছ ক্যাম্পোসের বড়ি ৷
তবু ঘুম আসে না আমার ৷
"জাগো হুশিয়ার !"
আমার মাথার মধ্যে হেঁকে যায় খ্যাপা চৌকিদার ৷

পাপগাথা


পাপগাথা
- কমলেশ পাল

ছড়ানো একান্ন পীঠে তুমি সতীমাতা
গুটাও পৃথুলা পূণ্য, রাখি পাপ-গাথা ৷
এ বোঝা একার নয়, সকলের দায়
অনুভব তুলে দিল আমার মাথায় ৷
সরো সতী ভাগ্যবতী শিব-সোহাগিনী
নামাই দুর্ভার এই কলঙ্ক-কাহিনী ৷

***


একটি মেয়ে শ্যামলা সরল করত শিবের ব্রত
শরীর ভরা জোয়ার তবু কুমারী অক্ষত ৷
ভিতরে এক রত্তি ছিল সুপ্ত মায়ের কুঁড়ি
স্বপ্নে ছিল অচিন যুবক পরাবে অঙ্গুরি ৷
নাম জানে না ধাম জানে না স্বপ্নে আসে যায়
দেহের কোটাল ফুরায় বুঝি দিন কাটে শঙ্কায় ৷
শিব-যামিনী চতুর্দশী রয় উপোসী মেয়ে
ভোলানাথের থেকে নিল একটি বর চেয়ে ৷

***


সেই বর এলো গোধূলি ভাসানো ইমনে
বর হয়ে এলো পুরুষ নারীর জীবনে ৷
মুখ তুলে চাও, ও মেয়ে ডাগর নয়না
খসাও কপট পানপাতা-ঢাকা ছলনা ৷

***


সালঙ্কারা কন্যা দেখে বর
সাত-পা হাঁটে বরের পিছু পিছু ৷
বরের সাথে মেলাতে অন্তর
আকাশ হল ঘাসের চেয়ে নিচু ৷
নতুন অনুভূতির ছোঁয়া আজ
পরুষ হাতে ধরা পেলব কর ৷
অনলে ঢালে আহুতি লঘু লাজ
মন্ত্র তার গহীন গাঢ় স্বর ৷

***


বেদে নাই, শাস্ত্রে নাই
নাই পুরোহিত-দর্পণে
সেই মন্ত্র বলে কন্যা
নিজের মনে মনে ৷

যে মন্ত্র পেয়েছে কন্যা
পুতুলের খেলায়
যে মন্ত্র পেয়েছে কন্যা
ব্রতে অনশনে
যে মন্ত্র পেলেছে কন্যা
আঁচলের তলায়
সেই মন্ত্র বলে কন্যা
নিজের মনে মনে .......

- "ধাইন্য কুসুম, ধাইন্য কুসুম
ধাইন্য কুসুম খই
অগ্নি সহবাসে থাইকো
যাবজ্জীবন সই ৷ "

***
স্বামী সহবাসে যাবে কন্যা গুণবতী
ছিঁড়িতে নাড়ির গ্রন্থি কাতর যুবতী ৷
পিছনে ফিরিয়া কন্যা মায়ের আঁচলে
কাঁদিতে কাঁদিতে চাল দিল ছুঁড়ে ফেলে ৷
"জন্ম-ঋণ-শোধ" শুনে মাতা মুর্ছা যায়
কেঁদে কন্যা জনকের চরণ ভাসায় ৷
ভাই কান্দে, ভগ্নী কান্দে, কান্দে পরিজন
আজন্মের স্মৃতি কান্দে দিতে বিসর্জন ৷
সিঁথিতে রক্তিম নদী, চন্দন কপালে
অচিন সাগরে ডিঙি গেল সন্ধ্যাকালে ৷

***
নগর-সরণি আজ উজান নদীটি
দুপাশের আলোজ্বলা বহুতল বাড়ি ও বাজার
এ মুহূর্তে জোনাকি-মানিক-গাঁথা হিজল পারুল -
মারুতি ময়ুরপঙ্খী - কোলাহল ভাটিয়ালী গান৷
সৌরভ সৌরভ লাগে, পাশে আছে স্বপ্নের পুরুষ
ক্যালেণ্ডার যা বলে বলুক - আজ তিথি দোলনিশি -
চাঁদনীর মুখে মাখা আবিরের ভালোবাসাবাসি -
নদীর মোহনা সরে যাও !

তবু যাত্রা শেষ হয় ৷ গাড়ি ভেড়ে তটে ৷
নতুন সংসার তটে আলো, ভিড়, বরণের উলু ........

***


ফিরেছে শিকার করে বরণের ডালি সাজা
এনেছে সোনার মৃগ উলু দে, শঙ্খ বাজা ৷
মেপে নে সোনার তবক ক'কেজি মাংস হবে
বধু, কাল-রাত্রি তোমার এ শুরু সন্ধ্যা সবে ৷
আমাদের পোশাক ভাষা টেনে নেয় নৃত্য আদিম
বাড়ি-ঘর অন্ধ গুহা পিশাচের বাজনা দ্রিদিম্ ৷
ছোপানো ঠোঁটের খাপে ধারালো দাঁতের ছুরি
বধূ তোর মেদের সাথে চাই মদ টাকার ঝুড়ি ৷

***


তারপর প্রতিরাত্রে অর্থহীন শরীর মন্থন ৷
প্রেমের অমৃত নয়, ওঠে শুধু বিষ ৷
স্বামীত্বের বলাত্কার মূল্য চায় প্রতিটি আঘাতে ৷

ভালোবাসা হাঁসের পালক
রাতভর কুকুরের আহারের পর
রক্তমাখা পড়ে থাকে বিছানার জঙ্গলের পাশে ৷

তবু বধু স্বপ্ন দ্যাখে -
অপরাহ্নে বাঁধে চুল, চোখে টানে মোহিনী-কাজল ৷
বাদল ঘনায় ঘোর, বধু হাঁস খোঁজে ..........

***


খুঁজিয়া না পান হংস পতির সংসারে
খুঁজিতে খুঁজিতে গেলা কৈলাস নগরে ৷
কপাটে কুটিলা মাথা জাগাতে বিধাতা
কন্যা দেখে আবির্ভূত শিব তার পিতা ৷
হাহাকার করে কন্যা - "কার হস্তে দিলা
কলসী বান্ধিয়া কন্ঠে জলে ভাসাইলা !"
বলে, সব বার্তা রাখি পিতার সাক্ষা‍‌ত্
"এ বর ফিরায়ে লও বাবা ভোলানাথ ৷
মোছাও সিঁথির রক্ত - বিবাহ কৌতুক
নয়, কন্যাযজ্ঞে ঢালো অনন্ত যৌতুক ৷"

***

বড় পাপকথা বলেছ, রমণী !
সিঁদূর সতীর চিহ্ন - বল্লভের আয়ুর কামনা -
তুমি তাকে মুছে দিতে চাও? মনে মনে তুমি হত্যাকারী !

কন্যাদান মহাদান, যৌতুক দক্ষিণা ৷
ধর্ম তুমি জানো না সম্যক ৷
জানে মনু প্রজাপতি, জানে অগ্নি - সাক্ষী বিবাহের ৷
স্বামীর যদৃচ্ছাতন্ত্রে মুখ ফুটে চেয়েছ অঙ্কুশ -
বড় পাপকথা বলেছ, রমণী !

***


বধূ তখন তার বিবাহের মন্ত্র স্মরণ করে ৷
প্রথম সাক্ষী প্রজাপতি ঋষিকেই সে ধরে ৷
পতির দলের প্রজাপতি সাক্ষী দিল না -
"নারী নরক যাওয়ার দুয়ার, দূর হয়ে তুই যা ৷"

***


যেতে যেতে যেতে যেতে ........
নখের মতো সরু আশার চন্দ্রকলা মরে;
অন্ধকারের সে অত্যাচার মুষল-ধারায় ঝরে ৷
ঘৃণার পাকে টলে কন্যা, চলতে সে অক্ষম
শেষ হতে চায় নিজেই নিজে, স্বামীও তার যম ৷

***


একদিন এমন সময়ে কেরোসিন, যজ্ঞের ঋত্বিক,
তরল করুণা হয়ে এলো তার কাছে ৷
স্বপ্নহীন শুষ্ক দাহ্য সমিধ-রমণী
প্রশ্ন করে তাকে :
"কোথায় দ্বিতীয় সাক্ষী?
আমার তো বিবাহ বৈদিক -
বেদান্ত মিথ্যা নয়,
উপস্থিত হোন তিনি -
বিবাহের শেষ সাক্ষী উপস্থিত হোন অগ্নিদেব !"

***


মন্ত্র সত্য, মন্ত্র সত্য, সর্বসত্য সতীর প্রার্থনা -
দীপশলাকার মুখে দেখা দিল জ্যোতির্ময় ফণা !
স্বামীর ধর্ষিতা নারী আজও মনে ব্রতের কুমারী,
দেহে তার রতি-তৃষ্ণা, আগুনেরও লেলিহান কাম
সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরে, আগুন জড়িয়ে ধরে নাচে ...........

***


"স্বৈরিণী ছুঁড়ে লজ্জা
করে আগুনের সাথে সঙ্গম ৷
আগুনের চুমা সারা গায়ে
আগুনের চুমা ওঁ ওঁ ৷

করে চিত্কার, না কি শিত্কার
পুড়ে পুড়ে দেয় ধিত্কার:
"ধরে থাক খিল কব্জা
চাখ্ পোড়া মাস-মজ্জা ৷"

স্বৈরিণী করে সঙ্গম
আগুনের চুমা ওঁ ওঁ

***


হুতাশন উড়ায় হুতাশ ৷ আগুন বধুকে নেয় ৷
ত্বক নেয়, চক্ষু নেয়, ওষ্ঠ বুক হৃদ দেহ নেয় ৷
হয়তো নারীর দু:খ স্মৃতি সুখ ভালোবাসা নেয় ৷
নেয় না সোনার চুড়ি, ঝুটা-মোতি দুটি কানফুল ৷
আগুন নেয় না নাভি, ফেলে যায় পাপের স্মারক ৷

***


যে অঙ্গ ভোগের শুধু অধিকারী পতি
অগ্নিকে তা দিয়ে কন্যা হইলা অসতী ৷
বাতাস নিল না ভস্ম, নেয় নাকো বারি
সীসার ওজন পাপ শিরে নিয়া ফিরি ৷
কার পাপ, ঠিকানা কি, জানি না তো নাম
সরো বা না-সরো সতী, আমি নামালাম ৷

***


"কী কব কষ্টের কথা, কারে বা জানাই -
মনুষ্য বধির অন্ধ, কাষ্ঠের সেপাই৷"
পোড়ালে জিয়ন্ত নারী, রটে পুণ্যকথা -
ছড়িয়ে বাহান্ন পীঠ কাঁদে নির্যাতিতা ৷

শিরোভূষণ

শিরোভূষণ
(কবি শক্তি চট্টোপদ্যায়ের প্রয়াণে)
                       - কমলেশ পাল
 
 
সবার হাতে শিরোভূষণ, সবার চোখে জল
নিজেকে রাজা বিলিয়ে দিল সবার হাতে হাতে ৷
ভালোবাসার গোধূলি মেখে বেভুল পদপাতে
প্রহর-পাড়ে পাগল ঘোরে, জানে না অকুস্থল ৷
সবার হাতে শিরোভূষণ, সবার চোখে জল ৷
 
আকাশ-জোড়া শিরোভূষণ, আকাশ-ভরা নীল -
মাটির থেকে অনতিদূরে দেখেই সাঁঝতারা
পাগল হাঁকে : আসছি আমি, দাড়ারে রাজা দাঁড়া ৷
প্রতিধ্বনি চতুর্দিকে : ভেঙেছে মহফিল ৷
আকাশ-জোড়া শিরোভূষণ, আকাশ-ভরা নীল ৷
 
পাগল আলাভোলা পাগল হেসেই কুটিকুটি -
"টিলায় ঘাস বিছানো হোলো, ঝর্ণা ঢালা হোলো
ওখানে তাঁকে দাঁড়াতে হবে পদ্যে টলোমলো ৷
আমাকে শিরোভূষণ দিয়ে তবে তো তাঁর ছুটি ৷"
পাগল আলাভোলা পাগল হেসেই কুটিকুটি ৷

লাল্লু রাজার যুদ্ধযাত্রা

লাল্লু রাজার যুদ্ধযাত্রা
                   - কমলেশ পাল
 
 
লোকে তাকে ডাকত লাল্লুরাজা৷ শুনলে সে খুশি হত ৷
তার তোবড়ানো মেঘলা মুখে ছড়িয়ে পড়ত এক ঝলক ফোকলা
হাসির রোদ্দুর ৷ অবশ্য আড়ালে তাকে বলতুম - লাল্লু চামার ৷
কেউ বলত - লাল্লু বুড়ো ৷

ভাঙা রাজবাড়ির সিংদরজায় বিছানো থাকত তার ছেঁড়া চটের
"রাজগদ্দি"৷ তার সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে জড়ো হত ফাঁটা চটি
ছেঁড়া জুতো, উলটানো চপ্পলের ভিড় ৷ থাকত তাদের একশ আট
রকমের বায়নাক্কা, একশ আট রকমের অভিযোগ ৷
 
ছুঁচ দিয়ে সে সেলাই করে দিত ফাঁটা চটির কাটা ঘা ৷
চামড়া জুড়ে মুড়ে দিত ছেঁড়া জুতোর হাহাকার ৷ পেরেক ঠুকে সে
মজবুত করে দিত ওল্টানো চপ্পলের নড়বড়ে মেরুদণ্ড ৷ কালি
বুলিয়ে, বুরুশ ঘষে উজ্জ্বল করে তুলত তাদের মলিন মুখশ্রী ৷
তাদের গায়ে ঠুক্ ঠুক্ করে টোকা মেরে বলত : "যাও বাচ্চা,
আগে বাড়্ হো"৷ তারপর, সেইসব হেরে-যাওয়া জুতো, চপ্পল,
চটিরা আবার নতুন চটি, দামী জুতোদের মাঝখান দিয়ে
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হেটে যেত ৷
 
ছেলেদের একটা মজা ছিল লাল্লুকে নিয়ে ৷ কেউ যদি বলত
-"লাল্লু, রাজবাড়িটা কার?" বুকে থাপ্পড় মেরে সে বলে উঠত
-"হামার, বাবু, হামার ৷"
 
সেই রাজবাড়ি আজ নিলাম হচ্ছে ৷ খদ্দেরে, দালালে, দর্শকে
গিজগিজ করছে ভিতরের প্রাঙ্গণ ৷ দালালের হাঁকে উড়ে যাচ্ছে
গোলা পায়রার ঝাঁক - উড়ে যাচ্ছে রাজবাড়ির পুরনো দিনের গল্প
ঝুরঝুর করে খসে পড়ছে কার্নিশ থেকে বালি - ঝরে পড়ছে
সামন্ত যুগের আভিজাত্য ৷
 
রাজবাড়ি নিলাম হচ্ছে ... লাল্লুবুড়ো তার রাজগদ্দি ঘাড়ে করে
চলে যাচ্ছে৷ বললুম : কি হে, রাজ্যপাট নিয়ে চল্লে কোথায়?
সে গম্ভীর ভাবে বলল : মকান পুরানা ছিল, ছোড়ে দিলাম ৷
হুই ..... পঁচ্চিশ তল্লা মকানের দখ্খল লিব ৷
 
শহরের সবচাইতে উঁচু বাড়িটার দিকে সে উঁচিয়ে ধরল
তার তর্জনী ৷ তার শীর্ণ লম্বা আঙুল মনে হচ্ছে যেন বন্দুকের নল ৷
তার দুটো লাল চোখ মনে হচ্ছে যেন বারুদ-ভরা টোটা ৷
লাল্লুরাজা যুদ্ধে চলেছে ৷

জননী


জননী
     - কমলেশ পাল
 
 
কতবার বলেছি তো মা -
এ ভাবে পথের মধ্যে
অপমান করা ভালো নয় ৷
লোকের ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় কৃতঘ্ন হৃদয় ৷
 
কেন আসো ? কেন এসে ডাক বারম্বার ?
তোমাকে ভুলেছি আমি
প্রখর অঙ্গন ছেড়ে ছায়া-মায়া-মোহ-মাধুরীতে
মোহিনী আড়াল খুঁজে চেয়েছি উদ্ধার ৷
 
তবু তুমি বাঁধো স্নেহে
তুমি তবু রিক্ত মাঠে, সিক্ত নদীকূলে
মানুষে, পতঙ্গে, জলে, তালবৃক্ষে, প্রতি তৃণমূলে
আঁচল বিছিয়ে ধর আকন্যাকুমারী ৷
 
কিছুই গৌরব নেই
তোমাকে যা দিয়ে যেতে পারি ৷

ফুল বিষয়ক

ফুল বিষয়ক
- কমলেশ পাল

চোখে চোখে তোলা ছিল বেড়া
গোলাপ প্রচ্ছন্ন ছিল পাতা আর কুঁড়ির ভিতরে
গোলাপ লুকোনো ছিল ঘরে -
আজ ভোরে ফুটেছে কেবল ৷
যার জন্য দিয়ে গেছি সার, ঢেলে গেছি জল
সে আর আমার নয়, এক যুবকের ৷
হে মালী ফেরাও কেন চোখ ?
সে ফুল বিদায় চায়
নাও দু:খ, নাও অল্প শোক ৷