Thursday, June 08, 2006

মোচ্ছব


মোচ্ছব
- কমলেশ পাল
 

আজ আমি খিচুড়ি খাব না ৷
প্রতিবারই ছ্যাড়ছ্যাড়ে খিচুড়ি খাওয়াও
শেষে পেট ভুট্‌ভাট্ করে ৷
 
আজ আমি রাস্তায় খাব না ৷
প্রতিবারই তাড়া দিয়ে রাস্তায় বসাও
কুকুরেরা পাতে মুখ দেয় ৷
 
আজ কলাপাতায় খাব না ৷
প্রতিবারই কাটাফাটা ছেঁড়া-পাতা দাও
চোখ বুঁজে নোংরা খেতে হয় ৷
 
যদি বল : নারায়ণ সেবা
তবে ঐ শালুমোড়া বেদীতে বসব
কাসাঁর থালায় আমি পরমান্ন খাব ৷
 
যদি বল : কাঙালী ভোজন
তবে এই ধম্মকম্ম মোচ্ছবের মুখে
লাথি মারি আমি ৷

চৌকিদার


চৌকিদার
- কমলেশ পাল
চিন্তা আমার রাতের চৌকিদার
ঘুমুতে দেয় না
সারারাত হাঁকে - হুঁশিয়ার ! হুঁশিয়ার !
*

অথচ ঘুমাব আমি
হাতের কাছেই আছে ক্যাম্পোসের বড়ি ৷
দরকারে একটি দুটি, দরকারে যতগুলি খুশি
গিললেই ডেকে নেবে অন্তহীন ঘুমের ঈশ্বরী ৷
এখন যা খুশি করা যায়
ইচ্ছে হলে মরা কিংবা ইচ্ছে হলে টিকে থাকা যায় ৷
মুহূর্তের ভীষ্ম আমি শুয়ে আছি শরের শয্যায় ৷
**

বাড়ির সবাই গেছে পূজার প্যাণ্ডেলে
বন্ধুবর্গ ধুনুচির নাচে
অথবা চুল্লুর ঠেকে, কেউ তিন-তাসে -
দিগন্ত প্লাবিত হচ্ছে মাইকের "জি লে লে" উচ্ছ্বাসে ৷
হবেই তো, আজ শ্যামাপূজা ৷
ইতিহাস পৃষ্ঠা থেকে হার্মাদ ডি-সুজা
রঘু কিংবা লম্বু পিপে ট্যারা
করালী রাত্রির পায়ে কষে দিচ্ছে শক্তির মহড়া -
এ পূজায় রক্ত চাই, মহাশঙ্খে আগ্নেয় কারণ ৷
শুনেছি, সেকালে নাকি নরবলি হোতো?
হোতো কি, এখনো হয় ৷ অতি সূক্ষ্ম মিহিন খর্পরে
কাটার পরেও মুণ্ড যথাযথ লেগে থাকে ঘাড়ে ৷
মুণ্ড যদি খেতে বসে, অফিসে দৌড়ায় কাটা ধড়;
ভিতরে ফিনকি দেয় রক্তের স্বাক্ষর;
শরীরের কোষে কোষে মৃত্যুর আক্ষেপ
থত্থর থত্থর কাঁপে, বাইরে স্বাভাবিক ৷
খোশগল্পে যেমন আমিও হাসিতে ঠাট্টায় আছি
কেরানি বাজারে মাছি বাসী-ফাইলে, পচা ডিসিপ্লিনে
সারাদিন ভন্ভন্ - সাহেবের থাপ্পড় এড়িয়ে
বাসে ট্রামে ভিড়েঠাসা ঝুলন্ত লোকালে
ভুলে কেউ পা-টুকু মাড়ালে বিশাল চক্কর তুলি
বিষহীন লাঞ্চিত লেজের ব্যবহারে ৷
***

অথচ সন্ধ্যার মুখে খুলেছিল হাসি -
যে হাসি মহার্ঘ খুব আমাদের দৈনিক জীবনে ৷
অত্যন্ত গোমড়ামুখো বাড়িরও কার্নিসে
বসেছিল হাসিখুশি প্রদীপের মেলা,
আতসবাজির খেলা, ফুলঝুরি তুবড়ি হাউই -
হুই .... হুই .... মল্লিকবাড়ির ছাদ ডিঙিয়ে পেরোচ্ছে
দুখুর উড়ন্ত সাধ, যে বেচে বাদাম৷
আজ সেও সত্যকাম, অন্তত সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ ৷
এক থেকে বহু হতে ঈশ্বর যেমন
এক শিখা সহস্র শিখায়
ঘরে মোম মেতেছিল আনন্দ খেলায় ৷
খেলা কি কেবল ঘরে?
খেলা চলে অসীম চত্তরে -
উপবৃত্ত গ্রহ-তারা সৃষ্টির শিশুরা
কালের কহ্লারে মগ্ন প্রজাপতি ঘিরে
অবিশ্রাম ঘুরে ঘুরে কানামাছি খেলে ৷
অথবা, লণ্ঠন জ্বেলে আলপথে যেন ফেরে গ্রামের বাড়িতে -
যেমন বোনাস পেয়ে কেউ কেউ পুজোর ক'দিন
মহানন্দে হিল্লিদিল্লি ঘুরে
ডোমজুড়ে, বালিচকে ফিরে আসি ছুটিশূন্য ফতুর পকেটে ৷
আমিও, হে অমারাত্রি, ঘুমঘরে ফিরে যেতে চাই ৷
***

তবু এই চতুর্দিকে শব্দমান পটকা দোদমা
তারই মাঝে দুটি একটি ছদ্মবেশী আকস্মিক বোমা
ঘুমের পয়ার ভাঙে৷ ছন্দে এসো সোমা -
এ বিকট শব্দে খুবই ভয় তুমি পেতে;
সদর রাস্তার ভিড়ে হেঁটে যেতে যেতে
অকস্মাত্ ডানা মেলে আমাকে জড়াতে ৷
সবটুকু ভয় নয়, কিছু ছিল সুন্দর ভেজাল,
যেভাবে সরিষা তেলে অপূর্ব মিশাল
শিয়লকাঁটার বীজ ৷
সোমা, তুমি শিকারী মাতাল
তির্যক নিশানা জানো ৷ সিংহের আহার
দুথাবা মাংসের টোপ রেখেছিলে অরণ্যে আমার ৷
আমি তো এলাম ফিরে ঘ্রাণ শুঁকে শুধু একবার ৷
পাড়ার সবাই জানে, আমাদের পুরনো সম্পর্ক গেছে চুকে ৷
ঠোঁটের রঞ্জক লেগে রক্তরেখা রয়ে গেল পাঞ্জাবির বুকে ৷
****

শুধুই কি সোমা নাকি? আরো, আরো কত
অদৃশ্য বুকের দাগগুলি
বিস্মৃতি সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে তুলি ৷
আমার মায়ের মুখ তুলি প্রথমেই -
তাম্বুলে জারিত ওষ্ঠ, দীপ্ত চক্ষু, কাঁচাপাকা দীর্ঘ কেশদাম
লক্ষ্মীর পটের সামনে গলবস্ত্র ভূমিষ্ঠ প্রণাম
দুঃখের সংসারে শীতে চন্দ্রপুলি হাসি
- গাড়ির সময় হোলো, মাগো তবে আসি .....
- যাসনে ঈশানে দ্যাবা ডাকে
ঘন ঘন চিল্লায় চিক্কুর
আমারে একলা ফেলে যাবি অত দূর !
তবুও গেলাম চলে যেভাবে তোমার
হাতের সোনার চুড়ি, কানপাশা, হার
একে একে গিয়েছিল সংসারের হাঁ-মুখ বোজাতে -
আমারও তেমনি যাওয়া
স্নেহের চৌকাঠ টপকে ডোরাকাটা হিংস্র রাজপথে ৷
*****

লাল-নীল, লাল-নীল, সবুজ হলুদ
চৌরাস্তায় চোখ মারে চারদিকে আলোর ইশারা৷
ধর্মতলার মোড়ে সব পথ সমান প্রধান!
নিচু হয়ে যে করে সেলাম, আর
মাথা-উঁচু যে সটান হাঁটে;
যে খাটে উদয় অস্ত, যারা গাঁট কাটে -
স্ব স্ব ক্ষেত্রে সবাই প্রধান ৷
মানুষখেকোর সাথে তৃণভোজী সভ্য নাগরিক
বস্তুত সিনেমা দ্যাখে, রেস্তোরাঁয় রাজনীতি ফাটায় ৷
যদিও প্রখর তাপে পিচ গলে গ্রীষ্মের দুপুরে;
কামুক চাকার দাঁতে পিষে যায় বেকারের বিধ্বস্ত হাওয়াই ৷
এবং বুধনরাম রিক্সা নিয়ে প্রাণান্ত দৌড়ায় -
তবুও শীতল কক্ষে জিঞ্জার বিয়ার
আইসক্রিম, গোল্ডস্পট, কচি ডাব, লস্যি পাওয়া যায় ৷
যারা তা পায় না, তারা তে-ইট উনুনে
শিয়ালদায় ভাত রাঁধে, ভিক্ষা করে, রাতে দেহ বেচে ৷
"আমরা তৃতীয় বিশ্বে নিরপেক্ষ সমৃদ্ধ স্বাধীন ৷" -
চতুর মুখোশলি যখন বহরে কথা বলে
চাপ-চাপ রক্ত মেখে কৃষ্ঞচূড়া জ্বলে ৷
******

জ্বলে কি? অথবা সবই দৃষ্টির বিভ্রম?
"ও চোখে চলবে না আর, পাওয়ার পাল্টান" -
বলেছিল সত্তরের দশকে ধীমান,
দীনেশবাবুর ছেলে, কচি মুখ, ধারালো সরল ৷
"সমস্ত শক্তির উত্স বন্দুকের নল ৷"
তার এ মুখস্থ যুক্তি বার বার ভ্রান্ত বলে দিয়েছি সরিয়ে ৷
তবু সে কালিমা রাত্রে ফিরে আসে রক্তজবা নিয়ে ৷
কেন আসে? কে তাকে ফেরার জন্য দোহাই দিয়েছে?
স্মৃতি তো অনেক গেল ধুয়ে
কারো বা মগজ থেকে মিটে গেছে বিপ্লবের ঘোর ৷
ধীমানের হৃ‌ৎ‌পিণ্ড গরম সীসায় কিন্তু হয়েছিল এফোঁড়-ওফোঁড় !
বিস্ফোরক শক্তি কিছু বন্দুকের নলে
অসম শ্রেণীর দ্বন্দ্বে সত্যি সত্যি ছিল -
মরে সে প্রমাণ করে গেল ৷
********

থামো চৌকিদার ৷
সে সব উত্তপ্ত দিন মধ্যরাতে জাগিয়ো না আর
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ৷
বরং জমিয়ে বসে গল্প হোক উড়ন্ত চাকির ৷
সেই যারা জ্যোত্স্নায় নি:শব্দে নামে সুনশান মাঠের শিয়রে;
কাচের মতন স্বচ্ছ মানুষেরা এসে
পৃথিবী জরিপ করে মিশে যায় ভোরের বাতাসে৷
অথবা সাগর কন্যা - নিম্নাঙ্গ মাছের
ঊর্ধ অঙ্গ খোলামেলা সোমত্ত নারীর !
(নারী অর্থে খেঁদি পেঁচি কালিদাসী নয় ৷
নারী মানে গ্রেটাগার্বো, মেরেলিন, ইত্যাকার সিনেমা সুন্দরী)
প্রবাল প্রাচীরে তারা গা এলিয়ে দিয়ে
নাবিক-পাগল-করা গান গায়
টুংটাং ঝিনুকের মন্দিরা বাজিয়ে ৷
বিশ্বাস হোলো না বুঝি? মনে মনে তাও
বিশ্বাসের চেষ্টা করে যাও,
স্নায়ু শান্ত হবে ৷
স্নায়ু যদি শান্ত হয়, ঘুম হবে নাকি?
ঘুমেরও ভিতরে আমি বস্তুময় স্বপ্নে জেগে থাকি ৷
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বস্তুময় ৷
বস্তুর অদৃশ্য কণা সূক্ষ্ম লেগে রয়
বস্তু থেকে উত্সারিত আমাদের স্বপ্নে চেতনায় -
যেমন ফুলের গন্ধে ফুলের নির্যাস
বাতসে সাঁতার কেটে অপরূপ ঢেউ তুলে তুলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে আনন্দ জাগায়,
স্নায়ুর স্পন্দনে জাগে মন -
মুদ্রিত কলির মধ্যে
স্বপ্ন এক স্তব্ধ জাগরণ ৷
রাতের মাস্তুলে বসা ডানামোড়া এল্‌বাট্রস পাখির মতন
ধূপ জ্বেলে সেতারে আঙুল রেখে চুপ বসে থাকা -
যা হতে পারিনি আমি, যে পরম পাওয়া -
যে আকাশ ছোঁয়া আজও বাকি রয়ে গেল,
তাই হওয়া, তাই পাওয়া -
সমস্ত ভাণ্ডার ছুঁতে চাওয়া ৷
********

হয়তো আমার চাওয়া প্রাচুর্যে ভূমায় ৷
একটি চুমায়
আমি পেতে চাই
জন্ম থেকে মৃত্যুব্যাপী
জীবনের সম্পূর্ণ আস্বাদ ৷
পৃথিবীর যাবতীয় লোহার গরাদ
ভেঙেচুরে গুঁড়ো হয়ে উড়ে যাক
মিলনের দামাল বাতাসে ৷
পাসপোর্ট ভিসা ছিঁড়ে খুলে যাক
সমস্ত সীমানা ৷
জানি, সেটা সহজে হবে না ৷
তবু, যারা অল্পে তৃপ্ত - মধুপর্ক বাটি দুফোঁটার -
ভাতে নুন লঙ্কা পেলে যারা বর্তে যায়
ফকরুর আব্বার মতো
দুকাঠার ডোবা কেটে দশগণ্ডা তেলাপিয়া ছেড়ে
ভেড়ির কর্তার মতো দাড়িতে সে আঙুল চালায় ৷
ভাসমান ছিপছিপে কলমির নিচে
স্বপ্নের মাছেরা খ্যালে,
উপরে মাচায় বর্ধমান লাউডগা, পুঁইলতা -
সন্ধ্যেবেলা ফোটে ঝিঙাফুল ......
বিলকুল মোক্তার অজ্ঞ, বিবি তার এ-বেলা উপোসী,
তিনতলা চাষ নিয়ে দুকাঠায় সে দারুণ খুশি ৷
ছোটো সে খুশির মধ্যে কোন্ ফাঁকে ঢুকে এক ঢোঁড়া
চোয়ালে মাছের চারা নিয়ে কাটে সোনালী সাঁতার ৷
হঠাত্ দেখতে পেয়ে চিল্লায় মোক্তার :
"ঐ শালা মোনসার পুত
রোজ মোর পোনা খেয়ি যায় -
ফকরু ! বারান্দা থেকি সাতনালা কোচটা নে' আয় ৷"
তখন ঢোঁড়াটি কয় দুহস্ত জুড়িয়া :
"তোমার তো বড়ো গোসা মিয়া !
মেরো না খেয়েছি পোনা, স্বীকার কসুর ৷
তোমার সংসার খায় বেনিয়া গোক্ষুর !!"
*********

এ তো দেখি কিস্সা হয়ে গেল ৷
তুমি জানো, সাপ তাকে কিছুই বলেনি;
চালাচ্ছো নিজের কথা, নাম দিয়ে ঢোঁড়ার জবানি ৷
রূপকে শব্দের প্যাঁচে এতক্ষণ গেলে শুধু খেলে -
পড়নি এখনও ধন, পণ্ডিতের মেলে ৷
সত্যই পালিয়ে ফিরি পণ্ডিতের ভয়ে ৷
দিকে দিকে সভাকক্ষে, বিশ্ববিদ্যালয়ে
যেখানেই যাই, দেখি, তালধ্বজ বিজ্ঞপ্রবরেরা
কূটতর্কে মেতে আছে হেতু - হেত্বাভাসে;
ছাত্রেরা ব্যায়ামে ব্যস্ত থিসিসের কঠিন প্রয়াসে !
আমি মূর্খ যাই কোন দিকে?
হাতে পেলে পাঁচ সিকে
কফি হাউসে পাঁচ ঘন্টা আড্ডা মারা যেত;
দিলীপ-শৌনক-রাম-মলয়কে নিয়ে
কবিতা কীর্তনে কিছু সিগারেট ধ্বংস করা যেত;
দ্বিজেনও এখানে নাই .......
পণ্ডিতের গন্ধ আসে - কুমারেশ ভৌমিকের দোকানে পালাই -
কথার শফরি আমি অল্প জলে সেখানে চমকাই ৷
এভাবে কর্তব্য মুড়ে খণ্ডে খণ্ড দীর্ঘ পলায়ন
পৌঁছে যেতে বোধিমূলে
গঞ্জিকা সেবন, ড্রাগ তুরীয় সমাধি;
মৃত্যু জরা ব্যাধি এড়াতে চোরের মতো
চুপিসাড়ে চেতনার প্রদীপে ফুত্কার ৷
জায়া-কন্যা-নন্দনের টান কেটে ছিঁড়ে
চাইবাসা থেকে আরো পশ্চিমে ভিতরে
কারো-নদী, কোয়েলের ধারে
পিয়ালের শ্যামল শালের আঙিনায়
নীল বড় চাঁদোয়ার নিচে চাঁদনীতে
আদিবাসী ঝুমুরের নাচের ধুলোটে
কষে খুব পলায়ন গেছে ৷
কত পাতা, কত ফুল টোপা-মহুলের,
কত যে শালের বীজ ঘুরে ঘুরে উড়ে গেছে চৈত্রী বাতাসে ......
পাইনি মুক্তির ঘ্রাণ ৷ সুজাতার ক্ষীরের পায়েস ছিল পড়ে শংকরের মায়ার সংসারে ৷
আবার ঘরেও ফিরে প্রাত্যহিক জীবন যাপনে
রয়ে গেল সেই ধুলো, ক্লান্ত সুর বিষণ্ন ঘুঘুর -
তিতির-তন্ময়-বনে গুটিগুটি পেরুনো দুপুর ৷
***********
"না রে না
ওটা কিন্তু দুপুর ছিল না ৷
গুটিগুটি পেরুচ্ছিল তোর আয়ু, বিশুদ্ধ সময় ৷"
রকের ইয়ার চাঁদু চক্রবর্তী কয় :
"এই সিদ্ধ আড্ডাসন ছেড়ে
শেষে কিনা চাইবাসা, কোয়েলের ধারে ৷
পাপ শুধু পূর্ণ নয়, হোলো তোর এক পোয়া বেশি ৷
এ দোষ খণ্ডাতে হলে এক কাজ কর্ -
কর্মফলরূপী একটি তুচ্ছ সিগারেট
আমাতে অর্পণ করে মুক্ত হয়ে যা ৷
"গুরু বল্ মন্ত্রী বল্, শিল্পপতি বল্
সবাই আমার জাত - চক্রবর্তী ৷ তোরা হলি দাস ৷
খেটেছিস কেবল ফরমাস,
এতকাল কর্মফল আমাদেরই পাদপদ্মে দিয়ে এসেছিস
ভক্তিতে না হলে ভয়ে, শ্রীমুখের বাণীর বদলে ৷
আরো দিবি ৷ না হলে নিস্তার নেই,
ঝাণ্ডাপার্টি দেব রসাতলে ৷"
- দ্যাখ না পারিস কিনা - দন্তে আমি ধরেছি সংসার ৷
চেয়ে দ্যাখ চক্রবর্তী, আমিই তৃতীয় অবতার !
************

দেখেছিস বিশ্বরূপ? এই চাঁদু, এই চন্দ্রনাথ ! .....
আমার গর্বিত ডাক খেল শূন্য চেয়ারে হোঁচট ৷
তবে কি মশারি বন্দি এতক্ষণ আমি
ফাঁকা তর্ক চালালাম বিছানার সাথে?
পোশাকে পেশায় বন্ধু, আমি আর তোমাদের বাঞ্ছনীয় নই;
শ্মশান-যাত্রার খই, ধুলো খাই, কুকুরেই চাটে ৷
অথচ, সেদিন ডেকে বিকাশেন্দু আমাকেই তুলত গাড়িতে ৷
সে নয় আমার মতো ফালতু ফতুর ৷
গ্যারেজে টয়োটা পোষে, ঘরে পোষে বিলিতি কুকুর,
অফিসে দারুণ পি. এ পারমিতা রায়
ডমরু কোমর নিয়ে নিজে নাচে, তাকেও নাচায় ৷
আমি কি নাচব নাকি, সে যখন বলে :
"কী সুন্দর লেখ তুমি ভাই
তোমার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই ৷"
মিথ্যা কথা ! দালালি ফাটকাবাজি আর যা-ই করে
বিকাশেন্দু ওরা কোনো কবিতা পড়ে না ৷
কেন না, কবিতা এক ম্যাজিক আয়না
সামনে দাঁড়ালে তার ফুটে ওঠে প্রতিচ্ছবি অমল আত্মার -
আমি যা ধরতে গিয়ে ভাঙি চুরমার ৷
**************

প্রতিটি ভগ্নাংশ জুড়ি খুঁটেখুঁটে আমি ই আবার ৷
প্রচণ্ড ঝড়ের পর টুকিটাকি গুছোনোর মতো
সম্পূর্ণ দেখব বলে শুদ্ধ করে নিজেকে সাজাই ৷
অথচ, নিজের করে নিজেকেই সাজানো কঠিন ৷
মানুষের কোনো আত্ম-অবয়ব নেই৷
বর্ণে ধর্মে ভাষায় জাতিতে খণ্ডিতের কোনো পূর্ণ পরিচয় নেই ৷
খণ্ডিত বাংলায় আমি অংশত মানুষ ৷
খণ্ডে ভয় ৷ ডাক বাজে চামুণ্ডা-তলায় ৷
হাড়িকাঠ - শুদ্ধিমন্ত্র পাঠ করে পুরুতমশায় ৷
ছাগের প্রার্থণা আজ কেউ শুনবে না -
বলির জোকার দেয় সমবেত কলোনী-ললনা ৷
মুখে মুখে জিভ নড়ে, মুখে জিভ লক্‌লক্ করে,
নিচে শিব - জেগে থাকা মঙ্গল মৃত্তিকা ৷
আণবিক উন্মাদিনী, যতই না উলঙ্গ লাফাও
শিব যদি টলে যায়, তোমার অস্তিত্ব ডুবে যাবে ৷
************

নড়ে কি কখনও শিব? ভিতড়ে খড়ের
নির্বোধ কাঠামো নিয়ে কুমোরের পাইকারী ছাঁচে
গড়াপেটা ভরা মুখে, আঁকা ত্রিনয়নে
চিত্পাত মাটির ঢিবি পড়ে আছে শিব !
আবার মাটির শিব লাঙলের নিবিড় কর্ষণে
ঋতুর উত্সবে মেতে হয়ে যায় শ্যামা গর্ভবতী
মাটি বড় অদ্ভুত রঙ্গিনী!
কলাবতী ভাস্করনন্দিনী আমাকে প্রসব করে
ডানা জুড়ে উড়িয়ে দিয়েছে ৷
আমি তাই স্বপ্নে উড়ি কবিতায় উড়ি ৷
"মাটির বাড়িতে যাব, খোলা বোধ!" -
বাতাসে বাতাসে মাথা খুঁড়ি ৷
**************

জানো, চৌকিদার?
এক রাতে স্বপ্নে মা আমার খুলে দিল শূন্যের বাঁধন ৷
"বুকে আয় ৷ তুইও এই মাটির লবণ" -
বলে সে জড়াল বুকে,
মাটির বিপুল স্তন গুঁজে দিল মুখে ৷ সেই থেকে
ঘাম, রক্ত, অশ্রু, কফ, চোখের পিঁচুটি সমস্ত লবণময় ৷
ধুলোর চুম্বন চেখে দ্বিধাহীন বলি :
তোমার ব্যঞ্জনে মাগো লবণ অধিক ৷
লবণ! লবণ!
চোখের জলের ঢেউ - চারিদিকে লবণ লহর !
গর্জায় রক্তের ঢেউ - ছুটে আসে লবণ লহর !
দুঃখের সন্তান আমি, লবণের গর্বিত পুতুল
বঞ্চনা-সম্ভূত জাগি রক্তবীজ লবণ অসুর
স্বর্গ আমি কেড়ে এনে ভাগ করে দেব অভাজনে ৷
মৃত্যু, তুমি কী দেখাও ভয়?
আমি আছি মায়ের শরণে ৷
*************

মাথার ভিতরে নাচে ঘুমহীন এ কি পাগলামি?
এ কঠিন চক্রব্যূহে একা কী করতে পারি আমি?
নোটে, ভোটে, হরিবোলে, বন্দুকের নলে
যে যেমন সিদ্ধহস্ত, যেখনে যা চলে
সব আয়োজন নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে রথীগণ ৷
আমি পদাতিক - সত্তর শতাংশ রিক্ত
মানুষের একক প্রতীক -
আমারই ঘুমের জন্যে সব আয়োজন !
হে দেবী, সকল ভূতে নিদ্রার কারণ
ভিডিও পার্লারে ব্যপ্ত টিভি-রেডিওতে -
সংবাদ সংসদ তুমি, বিজ্ঞাপন তুমি
আমার হাতের কাছে হয়ে আছ ক্যাম্পোসের বড়ি ৷
তবু ঘুম আসে না আমার ৷
"জাগো হুশিয়ার !"
আমার মাথার মধ্যে হেঁকে যায় খ্যাপা চৌকিদার ৷

পাপগাথা


পাপগাথা
- কমলেশ পাল

ছড়ানো একান্ন পীঠে তুমি সতীমাতা
গুটাও পৃথুলা পূণ্য, রাখি পাপ-গাথা ৷
এ বোঝা একার নয়, সকলের দায়
অনুভব তুলে দিল আমার মাথায় ৷
সরো সতী ভাগ্যবতী শিব-সোহাগিনী
নামাই দুর্ভার এই কলঙ্ক-কাহিনী ৷

***


একটি মেয়ে শ্যামলা সরল করত শিবের ব্রত
শরীর ভরা জোয়ার তবু কুমারী অক্ষত ৷
ভিতরে এক রত্তি ছিল সুপ্ত মায়ের কুঁড়ি
স্বপ্নে ছিল অচিন যুবক পরাবে অঙ্গুরি ৷
নাম জানে না ধাম জানে না স্বপ্নে আসে যায়
দেহের কোটাল ফুরায় বুঝি দিন কাটে শঙ্কায় ৷
শিব-যামিনী চতুর্দশী রয় উপোসী মেয়ে
ভোলানাথের থেকে নিল একটি বর চেয়ে ৷

***


সেই বর এলো গোধূলি ভাসানো ইমনে
বর হয়ে এলো পুরুষ নারীর জীবনে ৷
মুখ তুলে চাও, ও মেয়ে ডাগর নয়না
খসাও কপট পানপাতা-ঢাকা ছলনা ৷

***


সালঙ্কারা কন্যা দেখে বর
সাত-পা হাঁটে বরের পিছু পিছু ৷
বরের সাথে মেলাতে অন্তর
আকাশ হল ঘাসের চেয়ে নিচু ৷
নতুন অনুভূতির ছোঁয়া আজ
পরুষ হাতে ধরা পেলব কর ৷
অনলে ঢালে আহুতি লঘু লাজ
মন্ত্র তার গহীন গাঢ় স্বর ৷

***


বেদে নাই, শাস্ত্রে নাই
নাই পুরোহিত-দর্পণে
সেই মন্ত্র বলে কন্যা
নিজের মনে মনে ৷

যে মন্ত্র পেয়েছে কন্যা
পুতুলের খেলায়
যে মন্ত্র পেয়েছে কন্যা
ব্রতে অনশনে
যে মন্ত্র পেলেছে কন্যা
আঁচলের তলায়
সেই মন্ত্র বলে কন্যা
নিজের মনে মনে .......

- "ধাইন্য কুসুম, ধাইন্য কুসুম
ধাইন্য কুসুম খই
অগ্নি সহবাসে থাইকো
যাবজ্জীবন সই ৷ "

***
স্বামী সহবাসে যাবে কন্যা গুণবতী
ছিঁড়িতে নাড়ির গ্রন্থি কাতর যুবতী ৷
পিছনে ফিরিয়া কন্যা মায়ের আঁচলে
কাঁদিতে কাঁদিতে চাল দিল ছুঁড়ে ফেলে ৷
"জন্ম-ঋণ-শোধ" শুনে মাতা মুর্ছা যায়
কেঁদে কন্যা জনকের চরণ ভাসায় ৷
ভাই কান্দে, ভগ্নী কান্দে, কান্দে পরিজন
আজন্মের স্মৃতি কান্দে দিতে বিসর্জন ৷
সিঁথিতে রক্তিম নদী, চন্দন কপালে
অচিন সাগরে ডিঙি গেল সন্ধ্যাকালে ৷

***
নগর-সরণি আজ উজান নদীটি
দুপাশের আলোজ্বলা বহুতল বাড়ি ও বাজার
এ মুহূর্তে জোনাকি-মানিক-গাঁথা হিজল পারুল -
মারুতি ময়ুরপঙ্খী - কোলাহল ভাটিয়ালী গান৷
সৌরভ সৌরভ লাগে, পাশে আছে স্বপ্নের পুরুষ
ক্যালেণ্ডার যা বলে বলুক - আজ তিথি দোলনিশি -
চাঁদনীর মুখে মাখা আবিরের ভালোবাসাবাসি -
নদীর মোহনা সরে যাও !

তবু যাত্রা শেষ হয় ৷ গাড়ি ভেড়ে তটে ৷
নতুন সংসার তটে আলো, ভিড়, বরণের উলু ........

***


ফিরেছে শিকার করে বরণের ডালি সাজা
এনেছে সোনার মৃগ উলু দে, শঙ্খ বাজা ৷
মেপে নে সোনার তবক ক'কেজি মাংস হবে
বধু, কাল-রাত্রি তোমার এ শুরু সন্ধ্যা সবে ৷
আমাদের পোশাক ভাষা টেনে নেয় নৃত্য আদিম
বাড়ি-ঘর অন্ধ গুহা পিশাচের বাজনা দ্রিদিম্ ৷
ছোপানো ঠোঁটের খাপে ধারালো দাঁতের ছুরি
বধূ তোর মেদের সাথে চাই মদ টাকার ঝুড়ি ৷

***


তারপর প্রতিরাত্রে অর্থহীন শরীর মন্থন ৷
প্রেমের অমৃত নয়, ওঠে শুধু বিষ ৷
স্বামীত্বের বলাত্কার মূল্য চায় প্রতিটি আঘাতে ৷

ভালোবাসা হাঁসের পালক
রাতভর কুকুরের আহারের পর
রক্তমাখা পড়ে থাকে বিছানার জঙ্গলের পাশে ৷

তবু বধু স্বপ্ন দ্যাখে -
অপরাহ্নে বাঁধে চুল, চোখে টানে মোহিনী-কাজল ৷
বাদল ঘনায় ঘোর, বধু হাঁস খোঁজে ..........

***


খুঁজিয়া না পান হংস পতির সংসারে
খুঁজিতে খুঁজিতে গেলা কৈলাস নগরে ৷
কপাটে কুটিলা মাথা জাগাতে বিধাতা
কন্যা দেখে আবির্ভূত শিব তার পিতা ৷
হাহাকার করে কন্যা - "কার হস্তে দিলা
কলসী বান্ধিয়া কন্ঠে জলে ভাসাইলা !"
বলে, সব বার্তা রাখি পিতার সাক্ষা‍‌ত্
"এ বর ফিরায়ে লও বাবা ভোলানাথ ৷
মোছাও সিঁথির রক্ত - বিবাহ কৌতুক
নয়, কন্যাযজ্ঞে ঢালো অনন্ত যৌতুক ৷"

***

বড় পাপকথা বলেছ, রমণী !
সিঁদূর সতীর চিহ্ন - বল্লভের আয়ুর কামনা -
তুমি তাকে মুছে দিতে চাও? মনে মনে তুমি হত্যাকারী !

কন্যাদান মহাদান, যৌতুক দক্ষিণা ৷
ধর্ম তুমি জানো না সম্যক ৷
জানে মনু প্রজাপতি, জানে অগ্নি - সাক্ষী বিবাহের ৷
স্বামীর যদৃচ্ছাতন্ত্রে মুখ ফুটে চেয়েছ অঙ্কুশ -
বড় পাপকথা বলেছ, রমণী !

***


বধূ তখন তার বিবাহের মন্ত্র স্মরণ করে ৷
প্রথম সাক্ষী প্রজাপতি ঋষিকেই সে ধরে ৷
পতির দলের প্রজাপতি সাক্ষী দিল না -
"নারী নরক যাওয়ার দুয়ার, দূর হয়ে তুই যা ৷"

***


যেতে যেতে যেতে যেতে ........
নখের মতো সরু আশার চন্দ্রকলা মরে;
অন্ধকারের সে অত্যাচার মুষল-ধারায় ঝরে ৷
ঘৃণার পাকে টলে কন্যা, চলতে সে অক্ষম
শেষ হতে চায় নিজেই নিজে, স্বামীও তার যম ৷

***


একদিন এমন সময়ে কেরোসিন, যজ্ঞের ঋত্বিক,
তরল করুণা হয়ে এলো তার কাছে ৷
স্বপ্নহীন শুষ্ক দাহ্য সমিধ-রমণী
প্রশ্ন করে তাকে :
"কোথায় দ্বিতীয় সাক্ষী?
আমার তো বিবাহ বৈদিক -
বেদান্ত মিথ্যা নয়,
উপস্থিত হোন তিনি -
বিবাহের শেষ সাক্ষী উপস্থিত হোন অগ্নিদেব !"

***


মন্ত্র সত্য, মন্ত্র সত্য, সর্বসত্য সতীর প্রার্থনা -
দীপশলাকার মুখে দেখা দিল জ্যোতির্ময় ফণা !
স্বামীর ধর্ষিতা নারী আজও মনে ব্রতের কুমারী,
দেহে তার রতি-তৃষ্ণা, আগুনেরও লেলিহান কাম
সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরে, আগুন জড়িয়ে ধরে নাচে ...........

***


"স্বৈরিণী ছুঁড়ে লজ্জা
করে আগুনের সাথে সঙ্গম ৷
আগুনের চুমা সারা গায়ে
আগুনের চুমা ওঁ ওঁ ৷

করে চিত্কার, না কি শিত্কার
পুড়ে পুড়ে দেয় ধিত্কার:
"ধরে থাক খিল কব্জা
চাখ্ পোড়া মাস-মজ্জা ৷"

স্বৈরিণী করে সঙ্গম
আগুনের চুমা ওঁ ওঁ

***


হুতাশন উড়ায় হুতাশ ৷ আগুন বধুকে নেয় ৷
ত্বক নেয়, চক্ষু নেয়, ওষ্ঠ বুক হৃদ দেহ নেয় ৷
হয়তো নারীর দু:খ স্মৃতি সুখ ভালোবাসা নেয় ৷
নেয় না সোনার চুড়ি, ঝুটা-মোতি দুটি কানফুল ৷
আগুন নেয় না নাভি, ফেলে যায় পাপের স্মারক ৷

***


যে অঙ্গ ভোগের শুধু অধিকারী পতি
অগ্নিকে তা দিয়ে কন্যা হইলা অসতী ৷
বাতাস নিল না ভস্ম, নেয় নাকো বারি
সীসার ওজন পাপ শিরে নিয়া ফিরি ৷
কার পাপ, ঠিকানা কি, জানি না তো নাম
সরো বা না-সরো সতী, আমি নামালাম ৷

***


"কী কব কষ্টের কথা, কারে বা জানাই -
মনুষ্য বধির অন্ধ, কাষ্ঠের সেপাই৷"
পোড়ালে জিয়ন্ত নারী, রটে পুণ্যকথা -
ছড়িয়ে বাহান্ন পীঠ কাঁদে নির্যাতিতা ৷

শিরোভূষণ

শিরোভূষণ
(কবি শক্তি চট্টোপদ্যায়ের প্রয়াণে)
                       - কমলেশ পাল
 
 
সবার হাতে শিরোভূষণ, সবার চোখে জল
নিজেকে রাজা বিলিয়ে দিল সবার হাতে হাতে ৷
ভালোবাসার গোধূলি মেখে বেভুল পদপাতে
প্রহর-পাড়ে পাগল ঘোরে, জানে না অকুস্থল ৷
সবার হাতে শিরোভূষণ, সবার চোখে জল ৷
 
আকাশ-জোড়া শিরোভূষণ, আকাশ-ভরা নীল -
মাটির থেকে অনতিদূরে দেখেই সাঁঝতারা
পাগল হাঁকে : আসছি আমি, দাড়ারে রাজা দাঁড়া ৷
প্রতিধ্বনি চতুর্দিকে : ভেঙেছে মহফিল ৷
আকাশ-জোড়া শিরোভূষণ, আকাশ-ভরা নীল ৷
 
পাগল আলাভোলা পাগল হেসেই কুটিকুটি -
"টিলায় ঘাস বিছানো হোলো, ঝর্ণা ঢালা হোলো
ওখানে তাঁকে দাঁড়াতে হবে পদ্যে টলোমলো ৷
আমাকে শিরোভূষণ দিয়ে তবে তো তাঁর ছুটি ৷"
পাগল আলাভোলা পাগল হেসেই কুটিকুটি ৷

লাল্লু রাজার যুদ্ধযাত্রা

লাল্লু রাজার যুদ্ধযাত্রা
                   - কমলেশ পাল
 
 
লোকে তাকে ডাকত লাল্লুরাজা৷ শুনলে সে খুশি হত ৷
তার তোবড়ানো মেঘলা মুখে ছড়িয়ে পড়ত এক ঝলক ফোকলা
হাসির রোদ্দুর ৷ অবশ্য আড়ালে তাকে বলতুম - লাল্লু চামার ৷
কেউ বলত - লাল্লু বুড়ো ৷

ভাঙা রাজবাড়ির সিংদরজায় বিছানো থাকত তার ছেঁড়া চটের
"রাজগদ্দি"৷ তার সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে জড়ো হত ফাঁটা চটি
ছেঁড়া জুতো, উলটানো চপ্পলের ভিড় ৷ থাকত তাদের একশ আট
রকমের বায়নাক্কা, একশ আট রকমের অভিযোগ ৷
 
ছুঁচ দিয়ে সে সেলাই করে দিত ফাঁটা চটির কাটা ঘা ৷
চামড়া জুড়ে মুড়ে দিত ছেঁড়া জুতোর হাহাকার ৷ পেরেক ঠুকে সে
মজবুত করে দিত ওল্টানো চপ্পলের নড়বড়ে মেরুদণ্ড ৷ কালি
বুলিয়ে, বুরুশ ঘষে উজ্জ্বল করে তুলত তাদের মলিন মুখশ্রী ৷
তাদের গায়ে ঠুক্ ঠুক্ করে টোকা মেরে বলত : "যাও বাচ্চা,
আগে বাড়্ হো"৷ তারপর, সেইসব হেরে-যাওয়া জুতো, চপ্পল,
চটিরা আবার নতুন চটি, দামী জুতোদের মাঝখান দিয়ে
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হেটে যেত ৷
 
ছেলেদের একটা মজা ছিল লাল্লুকে নিয়ে ৷ কেউ যদি বলত
-"লাল্লু, রাজবাড়িটা কার?" বুকে থাপ্পড় মেরে সে বলে উঠত
-"হামার, বাবু, হামার ৷"
 
সেই রাজবাড়ি আজ নিলাম হচ্ছে ৷ খদ্দেরে, দালালে, দর্শকে
গিজগিজ করছে ভিতরের প্রাঙ্গণ ৷ দালালের হাঁকে উড়ে যাচ্ছে
গোলা পায়রার ঝাঁক - উড়ে যাচ্ছে রাজবাড়ির পুরনো দিনের গল্প
ঝুরঝুর করে খসে পড়ছে কার্নিশ থেকে বালি - ঝরে পড়ছে
সামন্ত যুগের আভিজাত্য ৷
 
রাজবাড়ি নিলাম হচ্ছে ... লাল্লুবুড়ো তার রাজগদ্দি ঘাড়ে করে
চলে যাচ্ছে৷ বললুম : কি হে, রাজ্যপাট নিয়ে চল্লে কোথায়?
সে গম্ভীর ভাবে বলল : মকান পুরানা ছিল, ছোড়ে দিলাম ৷
হুই ..... পঁচ্চিশ তল্লা মকানের দখ্খল লিব ৷
 
শহরের সবচাইতে উঁচু বাড়িটার দিকে সে উঁচিয়ে ধরল
তার তর্জনী ৷ তার শীর্ণ লম্বা আঙুল মনে হচ্ছে যেন বন্দুকের নল ৷
তার দুটো লাল চোখ মনে হচ্ছে যেন বারুদ-ভরা টোটা ৷
লাল্লুরাজা যুদ্ধে চলেছে ৷

জননী


জননী
     - কমলেশ পাল
 
 
কতবার বলেছি তো মা -
এ ভাবে পথের মধ্যে
অপমান করা ভালো নয় ৷
লোকের ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় কৃতঘ্ন হৃদয় ৷
 
কেন আসো ? কেন এসে ডাক বারম্বার ?
তোমাকে ভুলেছি আমি
প্রখর অঙ্গন ছেড়ে ছায়া-মায়া-মোহ-মাধুরীতে
মোহিনী আড়াল খুঁজে চেয়েছি উদ্ধার ৷
 
তবু তুমি বাঁধো স্নেহে
তুমি তবু রিক্ত মাঠে, সিক্ত নদীকূলে
মানুষে, পতঙ্গে, জলে, তালবৃক্ষে, প্রতি তৃণমূলে
আঁচল বিছিয়ে ধর আকন্যাকুমারী ৷
 
কিছুই গৌরব নেই
তোমাকে যা দিয়ে যেতে পারি ৷

ফুল বিষয়ক

ফুল বিষয়ক
- কমলেশ পাল

চোখে চোখে তোলা ছিল বেড়া
গোলাপ প্রচ্ছন্ন ছিল পাতা আর কুঁড়ির ভিতরে
গোলাপ লুকোনো ছিল ঘরে -
আজ ভোরে ফুটেছে কেবল ৷
যার জন্য দিয়ে গেছি সার, ঢেলে গেছি জল
সে আর আমার নয়, এক যুবকের ৷
হে মালী ফেরাও কেন চোখ ?
সে ফুল বিদায় চায়
নাও দু:খ, নাও অল্প শোক ৷

Wednesday, May 24, 2006

হাবুলদাকে ব্যক্তিগত

হাবুলদাকে ব্যক্তিগত
-- কমলেশ পাল


হাবুলদা, আমাকে তুমি নীলমাধব দেখাতে নিলে না৷
দিনভর ঝিরঝির বৃষ্টি, ছিপছিপে কাদায়
আমি এই কলকাতায়ই মেঘলা হয়ে আছি৷

জানো এ পূণ্যের দেশ, রথ-এ বৃষ্টি হয়৷
আফ্রিকায় বৃষ্টি নেই৷ ইথিওপিয়ায়
অনাহারে লোক মরছে কাতারে কাতারে
কোন পাপে, আমি তা জানি না৷

কার্জন পার্কের কোণে ঐ একটা লোক
দয়াধর্মে ছড়ানো পয়সার মধ্যে পাষাণ চত্বরে
পড়ে আছে হাত-পা-কাটা নি:সঙ্গ আদিম৷
আমার ভীষণ ভয় করে৷

ও যদি হঠাত্ আমাকেই বলে বসে -
"শোন্ কমলেশ, অমিই সেই নীলমাধব৷
চক্রীরা আমাকে ধরে কলকাতায় চালান করেছে" ৷

হাবুলদা, তখন তাকে কোন্ রথে, কোন্ পথ দিয়ে
নিয়ে যাবো কোন্ মর্যাদায়?

ফিনিক্স পাখিরা

ফিনিক্স পাখিরা
-- কমলেশ পাল

তোমরা মর না৷
তোমরা মৃতুর পুকুরে ডুবসাঁতার দিয়ে
এপারের প্রান্ত থেকে ওপারের প্রান্তে জেগে ওঠ৷
ইন্দোনেশিয়ার গণকবর থেকে
জেগে ওঠ কিউবায়;
কিউবা থেকে বলিভিয়ায়৷
তোমরা মর না৷
মৃত্যু তোমাদের পিছনে কুকুরের মতো হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়৷

তোমাদের জন্যে তৈরি হয়েছে হেমলক
তৈরি হয়েছে ক্রুশ
ফাঁসির দড়িতে ঘষা হয়েছে মোম
গ্যাস চেম্বার, বৈদ্যুতিক চেয়ার;
ঘাতকের হাতে রাইফেল তুলে দিয়ে
প্র্যাকটিস করানো হয়েছে বুল্স্ আই৷
তবু
এক একটি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তোমরা
দ্বিগুণ ভাবে বেঁচে ওঠ৷

এ যেন তোমাদের মরণঝাঁপের খেলা৷
মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছ
তার নিচে, অনেক অনেক নিচে
কূপের গভীরে টলটল করছে মৃত্যু ৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷

তোমরা
ভয়ের তোয়াক্কা না করে
শরীরে আগুন জ্বেলে
হঠাত্ই
লাফ দিয়ে নেমে যাও উল্কার মতন৷
আগুনের ডানা
মৃত্যুর কালো জলে ঝাপট মেরে
উড়ে যায়৷

দূরের গ্যালারি থেকে
ব্যক্তিগত নিরাপত্তা থেকে
শ্বাসরুদ্ধ আমরা দেখেছি
এইসব ভয়ঙ্কর খেলা৷
এখনও দেখছি

পৃথিবীর বিভিন্ন তাঁবুতে
তোমরা উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছ
মরণকূপের সামনে ঝকঝকে কিরিচের মতো৷

সার্কাসের মালিকের কাছে
ঈশ্বরের কাছে
সমস্ত রাষ্টের্র কাছে
রাষ্টস্রংঘের কাছোমরা প্রার্থনা করেছি :
আর নয়,
এইসব বিপজ্জনক খেলা সংক্রামক৷
প্রতিটি মরণঝাঁপ
আমাদের আগলে রাখা তরুণদের
মৃত্যুকূপের দিকে টেনে নিয়ে যায়৷
তোমরা মর না৷
তোমরা শুধু মৃত্যুকে তুচ্ছ করার
মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে যাও৷
হেমলক, ক্রুশ, ফাঁসি, গ্যাসচেম্বার
বৈদ্যুতিক চেয়ার, রাইফেল -
সমস্ত মৃত্যুর আয়োজনের উপর দাঁড়িয়ে
তোমরা উড্ডীন করছো
প্রাণের পতাকা৷

তোমরা সেই কিংবদন্তীর পাখি
যাকে পোড়ালে আবার নতুন করে বেঁচে ওঠে৷
যে একটা আগুনের যন্ত্রণা জড়িয়ে
অন্য একটা অগ্নিকাণ্ডের দিকে ছুটে যায়৷
যাকে ধরতে গিয়ে
মৃত্যু
আহত পশুর মতো
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, আর
সেই পাখি
মানুষের হদৃয়ের আকাশে আকাশে
উড়তেই থাকে ৷৷৷৷৷৷ উড়তেই থাকে ৷৷৷৷৷৷ উড়তেই থাকে

তোমরা মর না৷
পৃথিবীর ফিনিক্স পাখিরা
তোমরা বেঁচে থাক৷

পালিয়ে যেয়ো না

পালিয়ে যেয়ো না
-- কমলেশ পাল


পেলে না মুঠোয় প্রিয় কিছু
ছুটেছ ছায়ার পিছু পিছু
তুমি কিন্তু তা বলে কেঁদো না -

গাছে গাছে অজস্র বেদনা
ওগুলি ফুটলে হবে ফুল
স্থলপদ্ম আকন্দ বকুল৷

সত্যের মুকুট গ্যাছে ঝুঁকে?
রক্তছোপ মেঘেরও চিবুকে?
দেখে কিন্তু কেঁদো না, কেঁদো না -

দিকে দিকে চৌচির চেতনা,
তবুও বিশ্বাস - বারিধারা
তৃণে ঢেকে দেবে দেবেই সাহারা৷

দেখলে ফুলের বৃন্তে ফণা
শক্ত থেকো, পালিয়ে যেয়ো না৷

প্রেম

প্রেম
-- কমলেশ পাল


ফরাসী জানিনে আমি, প্রেম করি চুটিয়ে বাংলায়৷
মেজাজ খারাপ হলে কষে ঝাড়ি বাংলা খেউড়৷
উজানে গম্ভিরা শুনে ভেসে যাই
ভাটিয়ালি টানে -
সারি জারি বাউলে কেত্তনে
এ জীবন ধুলো করে যাই৷

রে ভাষা, জড়াতে তোকে শিশু হব, সাপ হব -
চেরা জিভে দুধ খাব দু-বাংলার গঙ্গা-পদ্মা হতে৷
মরে যাব তোর দেওয়া বর্ণমালা গলায় জড়িয়ে৷
বিষ দিলে বাংলা খাব, বিলিতি খাব না৷
নেশা করে মরে যাব -
সালাম বরকত হয়ে যাব,
আইফেল টাওয়ারে চড়ে
বাংলায় চেঁচাব
নির্দ্বিধায়৷

ফরাসী জনিনে আমি, প্রেম করি চুটিয়ে বাংলায়৷

প্রস্তাব

প্রস্তাব
-- কমলেশ পাল


বকুল বাংলোর কাছে প্রস্তাব রেখেছি

সে যেন আমার জন্য একখানি বেতের চেয়ার
অপেক্ষায় রাখে৷ আমি ঠিক পৌঁছে যাব দু"মিনিট আগে কিংবা পরে

যতক্ষণ ঘোড়া আছে ঝড় চিরে কেশর ওড়াব;
ঝালায় ফাটাব তান, যতক্ষণ স্নায়ু টান আছে;
এখনো বাতাস আছে অধিকন্তু বুকের হাপরে -
অ আ ক খ নানা বর্ণে ফোলাব বেলুন৷
ধুলোর পাগড়ি রুখু মাথায় জড়িয়ে
এখন মেলায় যচ্ছি৷ বাউণ্ডুলে স্বভাবের ট্যাঁকে
যা কিছু খুচরো আছে লোকায়ত উত্তরাধিকার -
তা দিয়ে জিলিপি কিনে লুট দেবো বাচ্চার দঙ্গলে;
লাবণ্যময়ীর জন্যে কস্তাপেড়ে হাসি নিয়ে যাব
টলোমলো দৃষ্টির দুয়ারে৷

তোমাদের অনুষ্ঠান সঠিক সময়ে ফোটা চাই৷
আমি ঠিক পৌঁছে যাব দুমিনিট আগে কিংবা পরে৷
বকুল বংলোয় যেন একখানি বেতের চেয়ার
আর চুপ অন্ধকার থাকে অপেক্ষায়৷

পাঁজরে খুরের ছাপ

পাঁজরে খুরের ছাপ
=========
-- কমলেশ পাল
খেলা ছিল অনুমতি প্রিয়
চৌকাঠ ডিঙোতে গেলে আমাদের স্নেহসিক্ত ঘর
বলে দিত : পেরিও না ডাকের সীমানা৷
যেও না বনের কাছে, বনে বৃক্ষ আছে;
অকারণ উত্তেজনা ফুটে থাকে বৃক্ষের শাখায়৷
পতাকা দণ্ডের মতো বন্যপথে রক্তাক্ত প্রত্যয়
জাগে অকস্মাত্৷

কোনো কোনো বৃক্ষকাষ্ঠে সম্ভাবিত দাবানল থাকে৷
তরুণ অশ্বত্থ ভাঙে মন্দিরের প্রাচীণ প্রথাকে৷
আমি কি ভেঙেছি কিছু শব্দ ছুঁড়ে লেখার খেলায়?
তবে এত হেষ্রা কেন? চোখে মুখে উন্মত্ত নি:শ্বাস!
ফেলেছ খুরের ছাপ স্বপ্নের পাঁজরে -
ঘোড়া ছেড়ে দেব না, সময়৷

বুক পকেটে ছিদ্র ছিল

বুক পকেটে ছিদ্র ছিল
===========
-- কমলেশ পাল
বুক পকেটে ছিদ্র ছিল, কলম গেছে ঝর্ণা সমেত৷
কলমভরা দুখ্খু-টুখ্খু, বিসর্গরূপ অশ্রুবিন্দু
পদ্য লিখে ফুরোয়নি যা -
কাটাকুটি রক্তপাতের পরেও ঈষত্
কোমার মধ্যে জ্যান্ত ছিল৷

মড়ার মতো আড়ষ্ট এক গোল্লাছুটের গঙ্গা প্রবল
ভগীরথের অপেক্ষাতে থাকতে থাকতে
পকেট গলে নিরুদ্দিষ্ট৷

হে কোতোয়াল,
চিত্র তাহার হয়নি তোলা৷

বিশেষ চিহ্ন? কোথায় পাব -
প্রমাণ হয়নি তেমন কোনো বিশিষ্টতাই৷
তবু হঠাত্ হাত বুলালে তারই জন্যে
বুকটা কেমন হাওয়া-হাওয়া ৷৷৷৷

আমার কি দোষ? দোষ খলিফার -
বুক-পকেটে ছিদ্র ছিল, কলম গেছে ঝর্ণা সমেত৷

নিলাম

নিলাম
===
-- কমলেশ পাল
গেলাস ভরা বিষাদ-সুরা
মেজাজ আছে খাসা
দালাল ধরে নিলাম করে দিয়েছি ভালোবাসা৷

সে টোলপরা পিতল ঘড়া, মলিন বাতিদান
আহত-ডানা পাথর-পরী আনত অভিমান৷
তাহাকে নিয়ে এভাবে হোতো
কঠিন জলে ভাসা
দালাল ধরে নিলাম করে দিয়েছি ভালোবাসা৷

এখনও আছে পুরোনো বেনারসীর কিছু জরি
এখনও আছে কাঁচুলি তার সিঁদুর মাখা কড়ি৷
দালাল ডাকো, রাখবো নাকো
বাতিল থাকে আশা৷
গেলাস ভরা বিষাদ-সুরা, মেজাজ আছে খাসা৷

একটি প্রেসার কুকার এবং ভারতবর্ষ

একটি প্রেসার কুকার এবং ভারতবর্ষ
কমলেশ পাল 

উনুনের সামনে আমার স্ত্রী হাঁটুর উপর থুতনি রেখে 
চুপচাপ বসে আছে৷ তার ফুট-চারেক দূরে 
আমাদের বাচ্চারা বসে আছে৷ 
উনুনের ওপরে প্রেসার কুকার৷ 
সেটি দু মিনিট অন্তর ছেড়ে যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস৷ 
ভিতরের তুমুল উত্তাপ, উত্তেজনা - 
মাংস আর মসলার তুলকালাম কাণ্ডকারখানা - 
মাঝে মাঝে ফোঁস্ করে ছড়িয়ে দিচ্ছে খানিকটা বাষ্প 
খানিকটা মসলার ঝাঁঝ৷ 

আজ দুপুরে দেখলাম, মৌলালি দিয়ে ধর্মতলায় 
ঢুকে যাচ্ছে কৃষকদের দীর্ঘ মিছিল৷ 
গতকাল আরও বড় শ্রমিক-জমায়েত নাকি বম্বেতে হয়েছে৷ 
গত পরশু দিল্লিতে বোটক্লাবের সামনে অনশন গেছে৷ 
আগামী-কাল ভারত বন্ধ্৷ 
গণতন্ত্র কাজ করছে৷ 
পরশু সবকটি নিরপেক্ষ সংবাদপত্রে ছাপা হবে 
সাফল্য এবং ব্যর্থতার খবর পাশাপাশি কলামে৷ 

ভারতবর্ষে প্রতিদিন একটা করে কারখানার দরজায় 
তালা ঝোলানো হচ্ছে৷ প্রতিদিন 
কয়েক হাজার শ্রমিক হাত কামড়াতে কামড়াতে বসে পড়ছে রাস্তায়৷ 
প্রতিদিন শত শত জমিহীন কৃষক 
গ্রামের মাটি থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে ছিট্কে পড়ছে শহরের য়্যাসফাল্টে৷ 

ভিড় বাড়ছে৷ ট্রাফিক-জ্যাম বাড়ছে৷ শনি বাড়ছে৷ গ্রহ-শান্তি বাড়ছে৷ 
লটারি বাড়ছে৷ আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বাড়ছে৷ 
নেতাদের আয়তন বাড়ছে৷ 
সরকারী পক্ষের নেতা এখন বিরোধী পক্ষের নেতার সঙ্গে 
ন-ইঞ্চি ডুবে যাওয়া স্পঞ্জের ডিভানে বসে সেফটি ভাল্ভ্ খুঁজছেন ...
 
দু-একটা খুন, দু-একটা বলাৎকার, দু-একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি 
বিক্ষোভ, বন্ধ্... পঞ্চাশ কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাস 
তাদের ঘৃণা এবং অবিশ্বাস... 
এর ভিতর দিয়ে কতটুকু বেরিয়ে আসতে পারছে? 
কিছু কিছু জমে যাচ্ছে না তো?...

ধুস্, তোমার প্রেসার কুকারটা এবার নামাও৷ 

সেই কখন থেকে একনাগাড়ে ফোঁসফোঁস করে যাচ্ছে - 
ঢাকনা খুলে দ্যাখো, হাড়-মাংস বোধ হয় আলাদা হয়ে গেল৷

বাড়ি ফিরে যাব

বাড়ি ফিরে যাব
-- কমলেশ পাল

ইচ্ছার পিছনে ইচ্ছে ছুটে যাচ্ছে ঝড়ের মতন
ট্রিগারে আঙুল রেখে তার পিছে ছুটে যাচ্ছি আমি৷
মৃগের পিছনে ব্যাধ, ব্যাধের পশ্চাতে
দুর্দান্ত শার্দুল ধাবমান৷

অরণ্য এখন স্তব্ধ
রুদ্ধশ্বাস দেখে যাচ্ছে এইসব রক্তাক্ত প্রস্তুতি৷
নদী শান্ত শুয়ে আছে নির্লিপ্ত জ্যোত্স্নায়
দূরে গ্রাম, নাম বাতাসিয়া
যাত্রার আসরে মাতে - হ্যাজাকের আলো৷
আমি কালো অন্ধকারে আরো ঘোর অন্ধকার খুঁজে
আমার ভিতরে আমি অপসৃয়মান৷

হে অরণ্য, কথা বল, ফেরাও আমাকে৷
নদী জেগে রুদ্ধ কর পথ৷
বাতাসিয়া, আমাকে বসাও ডেকে আলোকিত যাত্রার আসরে৷
ইচ্ছার পিছনে ইচ্ছে, তার পিছে আমি
মৃগতৃষ্ঞা আমাকে ছোটায়৷
মুঠোয় একাগ্নি-বাণ আমাকে ছোটায়৷
আমাকে জড়িয়ে ধর, ভালোবাসো, অস্ত্র কেড়ে নাও

পথ বল, বাড়ি ফিরে যাব৷

কোন সত্যে নিতে চাও

কোন সত্যে নিতে চাও
-- কমলেশ পাল

যা দেখেছি সবই নাকি ভুল৷

বাঁকানো আঙুল
খুলে নেয় বৃক্ষের শরীর থেকে ছাল৷
ভিতরের কুত্সিত কংকাল দেখা যায়৷
এই সত্য?
সত্যের সন্ধানে যেতে অতখানি দূর,
অতটা নিষ্ঠুর আমি কোন ধ্যানে নিজেকে বানাই?
আমি ভয় পাই৷

যা শুনেছি সবই নাকি ভুল৷

বাঁকানো আঙুল
ছিঁড়ে নেয় নদীটির নূপুর যখনই
তরঙ্গের অর্কেস্ট্রা সিম্ফনি থেমে যায়৷
এই সত্য?
সত্যের সন্ধানে যেতে ভুলে যাব সুর?
অতটা নিষ্ঠুর আমি কোন মন্ত্রে নিজেকে সাজাই!
আমি ভয় পাই৷

অন্ধ ও বধির করে কোন সত্যে নিতে চাও তুমি?
আমাকে করেছে বন্দী সবুজ সংগীতে বনভূমি৷

আড়ালে নিতাই চেল

"অবিশ্রাম রক্তের প্রপাত"" কাব্যগ্রন্থ থেকে

আড়ালে নিতাই চেল
- কমলেশ পাল

উপরে যে ফুল ফোটে, সেই ছবি সবটুকু নয়৷
হয়তো বৃক্ষের আছে অন্য কোনো গুপ্ত পরিচয়৷

পলাশ শিমুল বলে আমরা ফুলের নামে ডেকেছি তাদের
তবু তারা তাকায়নি ফিরে৷
যেন অন্য ধ্যানের গভীরে নীলিমায় ডুবে আছে ৷৷৷৷৷৷৷৷
যেন তারা বোলানের লালমণি দাস
হঠাত্ কলকাতায় এসে
টাটা-সেন্টারের দিকে চেয়ে আছে পলকবিহীন৷
কোর্টে তার কেস ছিল, এ মুহূর্তে বিষয়রহিত৷

হয়তো ফুলের কাছে আদপেই বৃক্ষটৃক্ষ নেই৷
ফুলের পাগড়ি খুলে ঐ উঁচু শাখায় টাঙিয়ে
বৃক্ষেরা ভ্রমণে গেছে শিকড়ের পথ বেয়ে অন্যত্র কোথাও৷
অথবা এ ছৌ-নাচ দড়ি বাঁধা ফুলের মুখোশ --
আড়ালে নিতাই চেল, গোপীনাথ, ভুবন মাহাতো, কালো মাঝি৷

উপরে যে ফুল ফোটে, সেই ছবি সবটুকু নয়৷
হয়তো বৃক্ষের আছে অন্য কোনো গুপ্ত পরিচয়৷





চিঠি

চিঠি
- কমলেশ পাল
ইস্পাত পাঠিয়ো কিন্তু সঙ্গে কিছু ভালোবাসা দিয়ো৷

আমাদের নিমাই কয়াল
প্রতিটি নাটকে যার মৃত-সৈনিকের
নি:শব্দ শয়ন ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা জোটে না -
তার জন্য কিছু দৃপ্ত সংলাপ পাঠিয়ো৷

কালোদার কন্যা সুমনাকে
জাপুরের পাত্রপক্ষ বাতিল করেছে৷
তার কোনো দোষ নেই, জন্মলগ্নে নক্ষত্র বিভ্রাট৷
কোথাও সন্ধানে যদি কেউ থাকে প্রকৃত পুরুষ
সত্বর পাঠিয়ো বরবেশে৷

এ তল্লাটে ভাদ্রমাসে দেবতা নামেনি৷
পারো তো ধানের বুকে দুধ করে পাঠিয়ো আশ্বিনে -
ইস্পাত অবশ্য দিয়ো, সঙ্গে দিয়ো হদৃয় প্রতুল৷

ঘুঁটে ও হামিদের নানী

ঘুঁটে ও হামিদের নানী
- কমলেশ পাল

আমাদের ঘুঁটে চাই উনুন জ্বালাতে
সে-ঘুঁটে জোগান দেয় হামিদের নানী৷
হামিদ ফেরার৷ তাকে থানাবাবু খোঁজে মাঝে মাঝে৷
হেঁসোর একটি কোপে আমিনুল্লা চৌধুরীর হাত
কেটে সে পালিয়ে গেছে৷ ধানের বখরা নিয়ে আগে
এরকম রক্তপাত হয়নিকো আমাদের গাঁয়ে৷
হামিদের কথা যদি জিজ্ঞাসা করে,
নানী বলবে : শত্তুর ! শত্তুর !

নানীর কোমরে বাত, ঝুঁকে গেছে হাড়ের কাঠামো৷
মাথায় শনের মতো রুখুশুখু না-তেল চুলের
নুড়ি নিয়ে ঝুড়ি কাঁখে ঘোরে মাঠে চৌপর দিন;
যখনই গোবর দ্যাখে খুঁটে তোলে ক্ষুধার্ত আঙুলে৷

রোদ্দুর ঝিমিয়ে এলে নানী দেয় ঘুঁটে৷
গোরের পাঁচিল জুড়ে তার শীর্ণ পাঁচ-আঙুলের
জেদী ছাপ ফুটে ওঠে অতি ক্রুদ্ধ ভ্রূকুটির মতো --
অজস্র চড়ের মতো তালতাল গোবরের ঘৃণা ও আক্রোশ
ছুঁড়ে দেয় বিরুদ্ধ দেওয়ালে --
পড়ন্ত আলোয় যেন চুল তার শিখা হয়ে ওড়ে৷
"শত্তুর ! শত্তুর !" প্রতিটি নি:শ্বাসে তার
নিপাতের বীজমন্ত্র ঝরে পড়ে সম্ভবা মাটিতে৷

শত্তুর হামিদ ? নাকি, হামিদের বিরুদ্ধবাদীরা?
উত্তর সহজ নয়৷ কেবল রাত্তির সন্নিপাতে
সময়ের নিদ্রাতুর দ্রোহহীন গালে
অজস্র ঘুঁটের চড় মেরে যায় হামিদের নানী৷

চশমা বদল

চশমা বদল
======
সন্দেহ করেছে কিছু, গোয়েন্দা পুলিশ গেছে ঘুরে
ডাকাত শিমুল এক স্নান করে রক্তের পুকুরে৷
এ দেখে অভ্যস্ত নই
এ ভাবে দেখেই জাগে ভয় -
আমার পুরনো চশমা কার সঙ্গে হল বিনিময় !
সে দেখতে কেমন ছিল?
শালপ্রাংশু অগ্নিহোত্রী ! পিত্তলে বাঁধানো ছিল বুক?
সে দেখতে কেমন ছিল?
এলোমেলো ভালোবাসা যুবকের মুখ?
সে কি কবি? রাজদ্রোহী? শিকড় উপড়ে ফেলা ঝড়?
সুতীক্ষÁ বর্শার মুখে বিদ্ধ করে দাঁতাল শূকর!
সেও কি আমার চশমা এঁটে আজ
ঝাপসা দেখছে দেশ-দশ-কাল-ভবিষ্যত্?
উজ্জ্বল আলোর ঝাপটা - অন্ধকারে ভুল করে পথ?
সে কি আজ রাজসাক্ষী? কর্তার দোহার?
সে কি আজ ভয় করে জেলখানা, অসহ্য প্রহার?
অথবা চশমায় নেই,
দ্বিতীয় যুদ্ধের আগে দেখে নিচ্ছে নির্ভুল নিশানা -
পাথরে ঘষার পর আঙুলে পরখ করে
তীব্র ছুরিখানা !
সন্দেহ করেছে কিছু, গোয়েন্দা পুলিশ গেছে ঘুরে
ডাকাত শিমুল এক স্নান করে রক্তের পুকুরে৷

সন্ত্রাস

সন্ত্রাস
===
রাস্তায় সন্ত্রাস ঘোরে
আমি থাকি ঘরের ভিতরে৷
চার-জোড়া কঠিন চোখ ঠিক্রে পড়ে
মুখের উপরে৷
৷৷৷৷ সে লোক কোথায় গেল, জেল-ভাঙা দস্যু পলাতক?
আপনার ভিতরে ঢুকে বেমালুম উবে গেল -
এটা খুবই সন্দেহজনক !
আমি বলি : জেল কেন, আরও কিছু
আরও শক্ত মায়ের আঁচল
ছিঁড়ে সে পালিয়েছিল৷
জানি সেও বৃত্তান্ত সকল৷
সে ডাকাতি করেছিল একরাশ ঠা ঠা জ্যোত্স্নালোকে-
মেয়েটি পাগল আজ সর্বহারা লুণ্ঠনের শোকে ৷ ৷৷৷৷৷
আমি তো নিজেই চাই, বন্ধ হোক কথার চালাকি
ঘরেও সন্ত্রাস ঢোকে যত কেন নিরপেক্ষ থাকি

রক্তের গভীরে

রক্তের গভীরে
=======
ঘাতক দেখেছি আমি, কখনও দেখিনি গুপ্তচর
ঘাতক বাইরে ছিল, গুপ্তচর রক্তের ভিতর
কোথায় একটি জবা ফুটেছিল রাজাদেশ ছাড়া
গোপনে মন্ত্রীর কানে এ সংবাদ তুলেছিল কারা
মুহূর্তে মশাল হাতে ছুটেছিল এক লক্ষ তেজী ঘোড়সোয়ার
পুড়েছিল জবার সংসার
"এসব দেখিনি আমরা" - চোখ বুজে বলি পরস্পর
ঘাতক বাইরে থাকে, গুপ্তচর রক্তের ভিতর৷

স্বদেশ

স্বদেশ
===
আমরা জেনেছি দেশে আমাদের পূর্ণ অধিকার
এর প্রতি ধূলিকণা রক্তে মিশে হয়েছে সোচ্চার

দাবির সনদ হাতে গিয়েছিল বলে
যে যুবক ঝরে গেল বন্দুকের নলে
কী করে বোঝাই তার মাকে
সে কাকে স্বদেশ বলে ডাকে৷

ও প্রাণ মৃদুল হাওয়া

ও প্রাণ মৃদুল হাওয়া
- কমলেশ পাল
=================================
কোথায় চলেছ ও প্রাণ মৃদুল হাওয়া?
সুদূরের এই প্ররোচনাটুকু শুধু কি তোমারই পাওয়া?
আমারো দুয়ারে অপেক্ষারত নিদ্রাকাতর ঘোড়া
গৃহস্থালির বোঁটায় ধরেছে প্রবাস বর্ণচোরা৷

হতৃপ্রসিদ্ধ দীঘির স্খলিত ঘাটে
প্রাচীণ পৃথুলা বটের অবেলা কাটে
অতিবৃষকায় অলস রোমন্থনে,
আমি জল ঢালি -
দোপাটির চারা লাগিয়েছি অঙ্গনে
কী যে প্রচণ্ড সময়ের চোরা টান!
তারই বিরুদ্ধে বেপথু দাঁড়িয়ে খুঁজি কিছু সমাধান৷
ভণ্ডুল ঘর গোছাতে গোছাতে আমারো আবছা যাওয়া৷
কোথায় চলেছ ও প্রাণ মৃদুল হাওয়া?

জেগে আছ সন্ন্যাসী ডাকাত

জেগে আছ সন্ন্যাসী ডাকাত
কমলেশ পাল
==============================
হদৃয়ে গাঁথবে বলে জেগে আছ ত্রিশূলের মতো৷
আঘাত ফেরাবে বলে
কব্জিতে থাপ্পড় জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছ৷
জেগে আছ লাল নুড়ি মাঝপথে সিঁদুর মাখানো
জেগে আছ অন্ধকারে সন্ন্যাসী ডাকাত৷

সে তোমাকে ছুঁয়ে গেছে কতবার গোপন গোকুলে৷
ত্রিশূলে রক্তের চিহ্ন
তুমি তাকে দেখেও দেখনি৷
সে তোমার নষ্ট-হাতে বার বার চুমু রেখে গেছে৷
হাতের তালুতে কিছু দ্রবনীয় স্নিগ্ধ অনুভুতি
বাতাস বাতাস কিছু গন্ধ মদিরতা -
তুমি যাকে ফেরাতে পারনি৷

কিছু কথা, কিছু শারীরিক
মেদ-মদ্য-প্রবণতা, অস্থির ভঙ্গিমা
কিছু ফুল, লোমশ জিঘাংসা কিছু, তীক্ষÁ ব্যবহার
তোমার মৃগয়া নিয়ে তুমি জেগে আছ৷

হদৃয় কখন এসে ব্রজরজ মেখে গেছে কপালে তোমার
তুমি তার কিছুই জাননা৷

সাগর তোমার জলে

সাগর তোমার জলে
---------
(1985 সালের মে মাসে বাংলাদেশের বিধ্বংসী বন্যার উপর লেখা)

সাগর তোমার জলে একদিন আমি
একগুচ্ছ কথামালা ভাসিয়েছিলাম৷
এখন সেখানে
মুগ্ধবোধ শব্দের বদলে
এক লক্ষ মানুষের শব ভেসে আছে৷
আমার প্রেমের তুমি মর্যাদা দিলে না৷

তবে জেনে রাখ
মানুষ আবার এসে মুছে যাওয়া মাটিতে দাঁড়াবে৷
আবার তাদের ঘর গৃহস্থালি হবে৷
তোমার ভ্রূকুটি ভুলে টিয়ারঙ ক্ষেতের কিনারে
মানুষের ভালবাসা গল্প করে যাবে৷

তখন তাদের নিয়ে লেখা হবে বিবিধ রচনা৷
এভাবে বানের জলে বার বার কথামালা ভাসাতে দেব না
বুক দিয়ে বেঁধে নেব বাঁধ৷

অভিমান স্থির পাললিক

অভিমান স্থির পাললিক
======================
"জলসখি শোন্" বলে লতানো মেয়েটি
কানে-কানে স্বপ্নকথা শোনাতো নদীকে৷
সে আজ জলের সাথে আড়ি দিয়ে
গুম বসে আছে৷

ফাগ ও চন্দন-মাখা কিছু নিশিলাজ
কেবল জলেরই কাছে মেলে ধরা গেছে এতদিন;
প্রদীপ ভাসানো গেছে ব্রত-অন্তে প্রিয় পতি চেয়ে৷
সেই জল গতরাত্রে ভেঙেছে বিশ্বাস -
ডাকিনী নদীর জল খেয়েছে মা-বাপ বাড়িঘর৷
কিছু নাই, কেউ নাই, স্বপ্নশূন্য বসে আছে মেয়ে -
পা-ছুঁয়ে ডাকাত-জল নির্দয় তামাশা খেলে যায় ৷৷৷৷৷

মেঘ বৃষ্টি হাওয়া হুহু নিয়ে
সর্ব অঙ্গ পাললিক, ভূমিকন্যা গুম বসে আছে -
"জলসখি" বলে আর ডাকবে না নদীকে কখনও৷

চক্ষুদান

চক্ষুদান
- কমলেশ পাল

হ্যাঙারে রয়েছি ঝুলে, মুখ নেই, পাঞ্জাবিতে আছি৷
হাত নেই, হাতাতে রয়েছি৷
যথেচ্ছ ছিল না দেহ, মুখ ভার ছিল -
তাদের ভাসান দিয়ে প্রভূত বাতাস হয়ে আছি৷

দেবচক্ষু চেয়েছিলে তুমি৷
অথচ আমার পক্ষে চশমার কাচ ছাড়া
শুভদৃষ্টি আয়ত্বে ছিল না৷
মধুময় ওষ্ঠ চেয়েছিলে৷
অথচ সেখানে পেলে দগ্ধ মাংসে তাম্রকূট জারিত বিস্বাদ৷

শরীর প্রাচীন ছিল, রটনায় ব্যবহতৃ ছিল৷
জরদব দলমাদলে ইতিহাস ছিল৷
দুই হাতে নিপীড়ন, আঙুলে আঙুলে বাঘনখ -
প্রবল আকর্ষ ছাড়া মুদ্রা-ভঙ্গি কিছুই ছিল না৷

আজ আমি সবটুকু শারীরিক অপরাধ খুলে
হ্যাঙারে পাঞ্জাবি হয়ে আছি৷
এইখানে তোমার পছন্দ-মতো কুমার সম্ভব দেহ দাও৷
গড় হাত দীর্ঘলয়ে, ওষ্ঠ মধুময় -
কাঁধের উপরে রাখ ইচ্ছাখুশি মুখ৷
মুখের উপরে ঝুঁকে প্রাণভরে দেবচক্ষু আঁকো৷

ডিম্বের প্রার্থনা

ডিম্বের প্রার্থনা
- কমলেশ পাল

যাদের সিদ্ধাই দেবে দাও
বিজ্ঞান বিভূতি দাও, প্রাণায়াম দাও৷
মানসাঙ্ক, শক্তপাঠ, তপতাপ আমাকে দিও না -
আমাকে প্রশ্রয় দাও ওমের আশ্রয়ে৷

যাদের আদর্শ দেবে দাও
নুনে গুণে গড়নে নিটোল গরিমায় -
বকের ব্রিগেড মঞ্চে দাও করে হংস সভাপতি৷
আমাকে ধূসর করে জিভে টুকু ছুঁয়ে দিও গান৷

যাদের সাফল্য দেবে দাও
তাদের সংসদ দাও, তাদের রাক্ষস-মুখে তথাগত রূপটান দাও
তাদের জোগান দাও গর্জমান বেলেল্লা প্রচার৷
আবডালে আমাকে বানাও বুলবুলি৷

যখন তুখোড়বৃন্দ ব্যস্ত রবে মুখস্থ জীবনে
তখন বেচাল শিসে ব্যাকরণ ভুল করে দেব হিসাবের৷



কথা ছিল

কথা ছিল
- কমলেশ পাল
====================================
গ্রীষ্ম যখন নুনে ঘামে এলোমেলো
হটাত্ দহন জুড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টি এলো৷
জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গাছগুলো সব
স্নান করে যায় মেঘ-সাওয়ারের নিচে নীরব৷
ভিতর থেকে বেজে ওঠে কার করাঘাত?
কথা ছিল তোমার সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ

সময় কোথায়? সামনে আমার মস্ত সিঁড়ি
মাড়িয়ে মানুষ চড়তে হবে রজত-গিরি৷
এমন সময় সমতলের সহজ গানে
বাউল পথের রাঙা ধুলোয় কে যে টানে?
আলিঙ্গনের জন্যে বাড়াই নষ্ট দুহাত -
কথা ছিল তোমার সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ

অরণ্যময় ধর্মে বাজে বাজনা দ্রিদিম -
ঘুমের থেকে লাফিয়ে ওঠে কিরাত আদিম!

হিংস্র পেশীর মুণ্ড-শিকার প্রবণতা
মুছতে থাকে তখন যে কার কাব্যগাথা ৷৷৷৷৷৷৷
ভালোবাসায় যায় গলে যায় কাতান করাত৷
কথা ছিল তোমার সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ

আকাশজোড়া অন্ধকারের বিজ্ঞাপনে
যায়রে ভোরের মুখচ্ছবি বিস্মরণে৷
টলছি যখন নেশাকাতর পণ্য মাতাল
শাঁখ বাজিয়ে ডাকল কে এক কালের রাখাল -
আলোর জন্য মশাল খোঁজে বিষন্ন রাত৷৷৷৷৷৷৷
কথা ছিল তোমার সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ৷


রবীন্দ্রনাথের মুখ

রবীন্দ্রনাথের মুখ
- কমলেশ পাল

দশ বছরের ছেলে টুকুন একটা কাগজে পেন্সিলের হিজিবিজি কেটে
বলল: দেখুন, রবীন্দ্রনাথের মুখ এঁকেছি৷ হয়নি?
দেখলাম৷ খাদা নাক, কুতকুতে চোখ, ছুঁচালো দাড়ি, আর
জঙ্গুলে চুলের এক বিচিত্রিত তুলকালাম কাণ্ডকারখানা৷
বললাম : বা:, চমত্কার৷
টুকুন খুশি হয়ে চলে গেল৷

টুকুন রবীন্দ্রনাথের মুখ আঁকতে পারেনি৷
আসলে, রবীন্দ্রনাথের মুখ আঁকা সহজ নয়৷
আঁকতে হলে চাই -
এক-আকাশ-উপুড়-করা মানুষের জন্যে ভালোবাসা৷
চাই একটা বৈশাখী ঝড়ের মতো খ্যাপা বাইসন
যে দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে
অন্য প্রান্তে ছুটে যায় চিরতে চিরতে -
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেই ঘাড়-কাত্-করা জেদ৷

রবীন্দ্রনাথের মুখ আঁকতে হলে চাই -
এক সাগর তৃষ্ঞা, এক টগর তৃপ্তি;
সমস্ত পাখির মুক্তি, সমস্ত গৃহের বন্ধন;
মায়ের যে মমতা শিশুর মুখের উপর জ্যোত্স্নার মতো ঝরে পড়ে;
শিশুর যে আনন্দ লুকিয়ে থাকে তার বাঁশি আর বেলুনের ভিতরে;
তুলির সেই ঘরছাড়া টান
যা বোলপুরের খোয়াই পেরিয়ে চলে যায়
আফ্রিকার নিবিড় রহস্যে;
সেই সব রঙ
যা দিয়ে সাগরকন্যারা ঝিনুকের বুকে ফুটিয়ে তোলে প্রজাপতি৷

সোজা কথা!
টুকুন এ সমস্ত পাবে কোথায়?
একজন শাশ্বত মানুষের মুখ একটা ছবির মধ্যে আঁটেই না৷
একজন শাশ্বত মানুষের মুখ -
যার ঠোঁট থেকে
পশুত্বের বিরুদ্ধে ছুটে যাচ্ছে
মৃত্যুকামী বারুদের গোলা;
আর একই সঙ্গে ঝরে পড়ছে
মানুষের জন্য অন্তহীন জীবন সঙ্গীত ৷৷৷৷৷৷৷৷

রবীন্দ্রনাথের মুখ আঁকা কি সোজা কথা!

আগুনের বর্ণমালা

আগুনের বর্ণমালা
- কমলেশ পাল
======================
চিতাশয্যয় শয়ন করে একজন অয়স্কান্ত পুরুষ
হুতাশনকে আদেশ করলেন :
অগ্নি, তুমি আমার নশ্বরতা লেহন কর৷

তিনি একজন যোদ্ধা এব ংকবি৷
তিনি তাঁর কলমটিকে বহুবার বহুযুদ্ধে
মানুষখেকো পশুত্বের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন
তীক্ষÁ বর্শাফলকের মতো৷

ক্ষুধার্ত মানুষের কান্না কাতরতা
শ্রমকাতর মানুষের পেশী-নিংড়ানো কালো ঘাম
ক্রুশবিদ্ধ মানুষের জবা-জবা রক্ত -
তাঁর বুকের বিশাল জলায়
মাটি, জল আর হোগলা বনের প্রান্তরে ঘুরতে ঘুরতে
মুদ্রিত হয়ে যেত কবিতার ভাষায়৷

সেই কবিতার উপর থেকে সরে গেল তাঁর হাত৷
সরে গেল তাঁর শারীরিক ছায়া৷
এখন স্পষ্টতই আমাদের সামনে তাঁর লেখা তাঁর উত্তরাধিকারী৷

যে আগুন তাঁর শরীরকে লেহন করে করেছে নি:শেষ
তাঁর লেখা, তাঁর কবিতা সেই আগুনকে লেহন করে
আমাদের সামনে দপ্দপ্ করে জ্বলছে৷

পরিচয়

পরিচয়
================
ভুল নামে ভুল পরিচয়ে
একটি মানুষ তার জীবেনের গল্প করে যায়৷
লোকটি প্রকৃত নয়, চেনা হয় অন্য পরিচয়ে৷

আমরা জেনেছি যাকে বোবা
কথা কয় আকারে ইঙ্গিতে
হয়তো ভিতরে তার ঝর্ঝর ঝর্ঝর
অহর্নিশ বয়ে যাচ্ছে গানের প্রপাত,
যা কাউকে শোনাতে পারে না৷

যে কসাই মাংস কাটে রক্তমাখা হাতে
আসলে সে চিত্রকর গোপনে কোথাও
যে কথা সে নিজেই জানে না৷

একটি বাউল আছে, পরিচয়, লৌহ ব্যবসায়ী৷
কোট প্যান্ট নেকটাই পরে
হেলসিঙ্কি আবুধাবি ছোটাছুটি করে
কেঁদুলি মেলায় তার যাওয়া হয়ে ওঠে না কখনও৷

কখনও ঘুমের মধ্যে এইসব মিথ্যা মানুষেরা
নিজেদের দেখা পেয়ে যায়৷
হটাত্ চিনতে পেরে নিজেদেরই গলা ধরে কাঁদে৷
অথচ সকাল হলে কোনো কথা মনেই থাকে না৷

কবন্ধের ভাবনা

কবন্ধের ভাবনা
- কমলেশ পাল
==========
আবার কোথায় কোন্ অভ্যুত্থান হোলো? ৷৷৷৷৷

বুদ্ধিজীবী দুটি ভূত এ-নিয়ে বারান্দা জুড়ে আলোচনা করে :
বেইরুটে নাকি সব দ্রুজ মিলিশিয়া? ৷৷৷৷
সব শালা পেন্টাগন !
এখানেও বিচ্ছিন্নতাবাদ ৷৷৷৷

কবন্ধের মাথা নেই, এর বেশি ভাবতে পারে না৷
একটির মাথা গেছে ব্যক্তিগত বাণিজ্য ভাঁড়ারে
অন্যটির মাথা গেছে রাষ্টীয় ভাগাড়ে -
মাথা নেই,
এর বেশি মাথা ব্যথা নেই৷

আবার কোথায় কোন অভ্যুত্থান হোলো? ৷৷৷৷
মানে, কোনো মিলিটারি ক্যুপ? ৷৷৷৷
একজন বলে : ভালো৷
অন্যজন ডেমোক্রাসি প্রিয়৷
অভ্যুত্থান মানে যদি গণজাগরণ? ৷৷৷৷৷
তা হলে তো কেলেঙ্কারি, আরেব্বাস্
সে তো গিয়ে বিপ্লব টিপ্লব৷
তা হলে আবার মাথা
এব ংনিজস্ব মাথা বইতে হবে ব্যক্তিগত ঘাড়ে ৷৷৷৷৷৷

এ নিয়ে কবন্ধ দুটি অন্ধকারে মৃদু লেজ নাড়ে৷

নচিকেতা

নচিকেতা
- কমলেশ পাল
===========
আমাকে দিয়েছ নির্বাসন৷
দিয়েছ মৃত্যুর হাতে -
তবে কেন মাঠেঘাটে রাস্তায় বাজারে
যারই সঙ্গে দেখা হয় তারই কাছে বল :
নচিকেতা নষ্ট হয়ে গেল৷
তবে কেন দু:খ কর লোকসভা বিধানসভায় :
সংসারে আমাকে রেখে নচিকেতা দূরে সরে যায়৷
মদ খায়, হল্লা করে, পেটো ছুঁড়ে মারে,
আজকাল মান্যজনে কেয়ার করে না৷
দেশের বিপদ সামনে -সীমান্তে ও ঘরে
অথচ সে উগ্রপন্থী, ছিন্ন হবে, আমাকে শাসায়৷
আমাকে সংসরে রেখে নচিকেতা দূরে সরে যায়৷
কাকে বল?
কার কথা বল?
পঁয়ত্রিশ বছর গেল, চেনাশোনা হয়নি এখনও?
রিগি ংমাষ্টার থেকে স্ট্রাইক ভাঙা ঠ্যাঙারে মস্তান
ভারতবর্ষের যেখানে নরক;
যেখানেই লোভ, হিংসা, সঞ্চয়, ক্ষমতা রাহাজানি
অন্ধকারে দেখাশোনা হয়েছে সেখানে৷
আলোহীন আগুনের মাঝখানে দেখাশোনা হয়েছে সেখানে৷
দিয়েছ মৃত্যুর হাতে
মদ ও বমির মধ্যে উল্টে আছি উত্তর পুরুষ৷

বৃদ্ধ, পঙ্গু, রুগ্ন গাভীগুলো নিয়ে যাচ্ছে দু:স্থ যাজকেরা -
পঞ্চবর্ষী যোজনার উত্তেজনা শান্ত হয়ে এলে
মাঠের মুনিষ থেকে কলের শ্রমিক
যজ্ঞ শেষে উদ্বৃত্ত কেবল৷
তদের চোখের সামনে অস্থিময় রাত্রি ছাড়া আর কিছু নেই৷
তাদের দৃষ্টির পথে পায়ে পায়ে আটকে যাওয়া দিন৷

আমি উদাসীন, বলি না তোমাকে আজ -
"কেন এই মিথ্যা প্রবঞ্চনা?"
এখন জড়ানো জিভে স্পষ্ট কোনও উচ্চারণ সহজে আসেনা৷
মহারাষ্টে, আসামে, পাঞ্জাবে

নিজেকে হনন ছাড়া অন্য কোনও আন্দোলন নেই৷
দুধালো গাভীর দিকে, অর্থ ক্ষমতার দিকে নি:স্বরা দেখে না৷
তবু তুমি দু:খ কর, নচিকেতা ছিন্ন হতে চায়!
নচিকেতা ছিন্ন হতে চায়?
না কি এ তোমার ভয়, নচিকেতা সম্পূর্ণ মরেনি৷
এখনও পীড়িত লোক কোলে তুলে নচিকেতা যায় হাসপাতালে৷
এখনও গাছের ডালে পাখি দেখলে বলে ওঠে, বা:৷
নচিকেতা পাল্টে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে৷
ছিন্ন নয়, যেন তার সংঘবদ্ধ ফিরে আসা আছে৷
মৃত্যুর ভিতর থেকে জীবনের কাছে ফেরা আছে৷
ফেরা আছে ৷৷৷
ফেরা আছে ৷৷৷
আছে৷

দিয়ে যাব কৃপাণ জাগিয়ে

দিয়ে যাব কৃপাণ জাগিয়ে
=============
বাতাস ঘুরিয়ে দিয়ে যাব৷
সইতে পারিনা আমি মুণ্ডমালা গাঁথা৷
কুঁড়ির মতন এই শিশুটিকে ছিঁড়ে
কে এনেছ রেস্তোরায় বাজারি সেবায়?
বাজার গুঁড়িয়ে দিয়ে যাব৷

কুঁড়ি আমি ভালোবাসি, ফুল ভালোবাসি৷
প্রিয়াকে ফুলের নামে ডাকি মধ্যযামে৷
নৈR্তে ভ্রুকুটি দেখে যাকে ডাকি :
কিংশুক ! কিংশুক !
সে আমার কনিষ্ঠ সন্তান৷
সমস্ত উজাড় দেশ করে যাব ফুলের বাগান৷

বাঁকানো ধাতুর দম্ভে কেউ যদি বাড়াও আঙুল;
একটি কলিরও যদি স্পর্শ কর চুল -
দিয়ে যাব কৃপাণ জাগিয়ে৷

ফুল, তোরা নির্ভয়ে ফুটিস দেশময়;
ঝকমক করে যেন প্রতিটি পরাগে সূর্যোদয়৷

আমার ভাইয়ের রক্ত

আমার ভাইয়ের রক্ত
=============
খুব যে ঘোরাচ্ছ খাঁড়া ধর্ম ধর্ম করে ৷৷৷৷
রঘুপতি,
আমার ভাইয়ের রক্ত
এক ফোঁটা তোমাকে দেব না৷
রক্ত এত সস্তা নয় যে ঢেলে দেব ছুরির ফলায়৷
যদি লাগে, রক্ত দেব ল্যুকোমিয়ায় ভোগা মেয়েটিকে৷
আমার ভাইয়ের রক্ত পাবে ঐ কারখানার আহত যুবক৷
আমাদের রক্ত পেয়ে সুস্থ হয়ে হেঁটে যাবে জরিনা অরুণ৷

ধর্ম যদি আকাশের গোরাচাঁদ হয়ে
জ্যোত্স্নার মতন প্রেম জনে জনে বিলোতে না পারে
তবে সে কৃপণ মরে যাক৷

নি:স্ব হলে ঝরে যাক, উড়ে-পুড়ে যাক -
সে ধর্ম নিজেকে খাক, মানুষের রক্ত কেন খাবে?

রঘুপতি,
ধর্মে তুমি জাগিয়েছ খড়গের পিপাসা -
আমার ভাইয়ের রক্ত এক ফোঁটা তোমাকে দেবো না৷

পাঁচিল

পাঁচিল
- কমলেশ পাল ("সেই মুখ সেই আর্তনাদ" কাব্যগ্রন্থ থেকে)
============================
দুটি বাড়ি পাশাপাশি, তাদের সম্পর্ক পঁচিলের৷

এ বাড়িটি বড় নয়,
ও বাড়িটি এর চেয়ে বেশি কিছু নয়৷
কেবল দু-পাশ থেকে দুই জোড়া হাত
বড় করে উঁচু করে তুলেছে পাঁচিল৷

যতটা উন্নত হলে -
এ বাড়ির বুক
ও বাড়ির বুকের অসুখ
কতখানি, জানতে পারে না;

এ বাড়ির মুখ
ও বাড়ির মুখে চুমু
খেতে গিয়ে ঘষা-খায় বালির দেয়ালে -
পাঁচিল উঠেছে ততখানি৷

এখন এ ওর দিকে ছুঁড়ে দেয় অ্যান্টেনার উদ্ধত ভ্রূকুটি৷

প্রতিটি হত্যার বিরুদ্ধে

প্রতিটি হত্যার বিরুদ্ধে
- কমলেশ পাল
==============
নামিবিয়ার যে কালো মানুষটি
প্রিটোরিয়ার সাদা জল্লাদের হাতে মরছে
তার জন্য রইল এক বিন্দু অশ্রু৷

লেবাননের উদ্বাস্তু শিবিরে যে আরব শিশুটি
ইস্রাইলের পাশবিক বোমায় নিহত
তার জন্য রইল একটি দীর্ঘশ্বাস৷

নিকারাগুয়ার যে তামাটে কৃষকটি
তার প্রিয় খামারের মধ্যে
সাম্রাজ্যবাদীর গুপ্ত বুলেটে
ঝাঁঝরা হওয়া বুকে উপুড় হয়ে পড়ে আছে
তার জন্য রইল একটি রক্তগোলাপ৷

ভারতবর্ষের যে অস্থিসার বৃদ্ধাটি
কেবলমাত্র একমুষ্টি ভাতের অভাবে মারা গেল -
তার হত্যাকারীকে খুঁজতে গিয়ে
সত্তর কোটি মানুষের মুখের উপর দিয়ে ঘুরে এলো
আমার সন্দেহ৷
সনাক্ত করব আমি কাকে?
হে বৃদ্ধা, তোমার জন্য আমার কী রইল?

আমার বা-ঁপকেটে সিগারেট আর ডান পকেটে দেশলাই
এই আমি দেশলাই ঠুকে তোমার আঁচলে
লাগিয়ে দিলুম আগুন৷

মা, তুমি জ্বলে ওঠো৷

গাণ্ডীবের তৃতীয় নয়নে

গাণ্ডীবের তৃতীয় নয়নে
- কমলেশ পাল
==========================
পার্থ ক্ষমা কর৷
বুড়ো-হাড়ে আর তুমি টংকার তুলো না৷
ভেঙে যাব, গুঁড়ো হয়ে যাব৷

অনেকের মুণ্ডু কেটে দিয়েছি তোমাকে
অনেকের হত্পিণ্ড, অনেক মুকুট ৷৷৷৷৷
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে গাণ্ডীবের তুল্য কোনো
মস্তান ছিল না৷
তোমার নিমিত্ত আমি
কারো বা নিমিত্ত তুমি
কারো দৈবাদেশে ৷৷৷৷৷
পার্থ, হাতে বড় রক্ত লেগে আছে৷
গৌরব যে এত কালো, কীর্তি যে এত লজ্জাকর
ভেবেছ কখনও?
একদিন নিহত বাঘের বুকে
পা রেখে যে তুলিয়েছি ছবি -
জয়স্তম্ভ গড়িয়েছি হত্যার উপরে,
তা যে এত ভয়ংকর, কদর্য কুত্সিত -
মন্দিরের মধ্যে এত অন্ধকার, মিথ্যা বিশ্বরূপ-
খুন ও হত্যার মধ্যে শব্দের চাতুর্য ছাড়া
নেই কোনো মহত্ অভিধা -
বুঝতে পারিনি৷

আজ এই উপান্ত বয়সে
অশক্ত কাঠের চাপ-এ আর কোনো সম্ভবামি নেই৷
মাটির শরীর ফুটে বেরিয়েছে আমাদের গোপন সন্ত্রাস৷

মৃত্যুর সংগীত আর রণবাদ্য মুলতুবি রেখে
প্রতিষ্ঠা ও করতালি মুলতুবি রেখে
আমরা দেখিনি
ভাঙা ঘর, ছেঁড়া মুখ, উলঙ্গ শরীর -
পিঁপড়ের মতো
মানুষের ইতস্তত অন্নের সন্ধান -
স্তুপীকৃত দরখাস্তের নিচে

বেকারের অপব্যয়ী লাশ৷
আমরা তো দর্পণ দেখিনি৷

এ বয়সে কার দিকে ছুঁড়ে দেব তীর?
দুটো চোখে ছানি হলে তৃতীয় নয়ন ওঠে জেগে
প্রকৃত লক্ষের দিকে কেঁপে ওঠে কঠিন তর্জনী৷
পার্থ, তুমি টংকার তুলো না -
তোমাকেই বিঁধে ফেলতে পারি৷

গোলাপ নির্যাস

গোলাপ নির্যাস
- কমলেশ পাল
===============
তোমার আতরদানে গোলাপের রক্ত লেগে আছে৷

এ কথা সুগন্ধে নাই
বিজ্ঞাপনে একথা ছিল না
সেখানে চিত্রিত ছিল কোনো এক সুন্দরীর মুখ৷

এ কথা থাকে না লেখা
আমি একা স্বভাবের দোষে
রক্ত দেখে চমকে উঠি সিল্কের পোশাকে;
টানাপোড়েনের মাঝে কাশির ধমক শুনি
শিশুদের অনাহার শুনি

নিতান্ত স্বভাব দোষ৷
না হলে কি কবিতার মাঝখানে এইভাবে করোটি নাচাই!

ভাই, যেখানে যাবার আছে যাও
সিল্কের পাঞ্জাবি পরে ফুলের নির্যাস মেখে যাও৷
কেবল নজর থাকে যেন
আমাদের পরিচ্ছন্ন প্রতিটি জামায়
তাঁতিদের রক্ত লেগে থাকে৷

কুনারামের দেশ দর্শন

কুনারামের দেশ দর্শন
-কমলেশ পাল
===========================
হ্যা ব নুনা, পাত-পালা বিচে
তুকে যে চার কিলাস তক্ পড়্হালম
ত, কি শিখলি?
মুদের দ্যাশটো চিন্হতে লারলি ৷৷৷৷
মুদের দ্যাশটো চিন্হতে লারলি ৷৷৷৷
কীটো শিখ্লি?

পড়্হেছে বটে বাবুর ছা-টো!
বইল্লেক্ : কুনারাম, জমিনের কাজটো সাইর্লে?
বইল্লম : নাই সাইর্ল৷ টুকু বাকি রহি গেল৷
বেজাই রইদ্, কাড়ার চাম ফাটে যাবেক৷
ত, মুই ফাব্ড়া ছাড়ি নাই হে!
এব্রে দমে ভুখ্ লাইগে গেল ৷৷৷৷
মনে লিছে পেটে শাবল হুইড়্ছে৷
খাতে যাছি৷

ত, উ বইল্লেক : খাবার কথাটৈ ভাইব্ছ?
দ্যাশের কথাটো ভাইব্ছ নাই?
বইল্লম: মুরুক্ষু লোক আইজ্ঞা


পেটের ধান্দতে জেবনটো কাইটে গেল -
দ্যাশ চিন্হ্তে লাইর্লম৷

ত, বাবুর ছিলাটো মোকে, ডাইকে, জান্লা বাগে
ঘরের ভিতরকে ভাইল্তে বইল্লেক -
: হুই দেখ্অ কুনারাম, উটো মুদের দ্যাশ৷
উপরকে মিহাল পাহাড়, লিচে ভারতসাগর!

দেইখ্লাম! দ্যাশটো কাগজের বটে ৷৷৷৷৷

হ্যা ব নুনা, মোর বাপটো দেইখ্তে পালেক নাই ৷৷৷৷৷৷
মুই দেইখ্তে পালি নাই ৷৷৷৷৷৷
তু দেইখ্তে পালি নাই
দেশটো গোটাই বাবুরা ঘরকে সিমাই লিলেক !
অহ্হ হ: হ: হ -
মুদের সকলের চইখে বাবুরা ভেলা ঘষি দিঁইছে ৷৷৷৷৷৷

ত, লাগড়াটোকে পিটি-করি হাঁকড়াইঁ দে -
হেই ই ৷৷ ই৷৷৷ গরীব লোকমান৷৷৷৷৷৷
মুদের দ্যাশটোকে বাবুরা ঘরকে সিমাইঁ লিন্ছে হে ৷৷৷৷
তুমরা আইস হে ৷৷৷৷
দল বাঁইধে আইস হে ৷৷৷৷৷
মুদের দ্যাশটো বাহারকে আইন্তে হবেক ..... !!

পলিপ্যাকে মাদার ডেয়ারি

পলিপ্যাকে মাদার ডেয়ারি
----------------------
অঝোরে রোদ্দুর ঝরছে
লোকটি যাচ্ছে তারই মধ্যে দারুণ মেজাজে৷
ছাতা নেই, অথচ কী ভাবে
দুপুর অগ্রাহ্য করে হাটছে স্বাভাবিক! -
তোমার বিস্ময়৷

অবশ্যই ছাতা একটি আছে
যা অদৃশ্য আমাদের ধুলোপড়া আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে
আমরা কি দেখতে পাচ্ছি, ওপাড়ার তুমুল মেয়েটি

বসে আত্ছে খোলা ব্যালকনিতে?

আমরা কি দেখতে পাই? -
বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে আঁকা আছে সমুদ্রের ছবি;
জড়বুদ্ধি বালকের অন্ধকার মনে
পদ্মাসনে বসে আছে কবি৷

অনেক ফুলের গন্ধ, পাতার মর্মর
এভাবেই রয়ে গেল সীমাবদ্ধ দৃষ্টির ওপারে -
যা সব দেখতে হলে ধপধপে হদৃয়ের হালকা খুঁট দিয়ে
চোখ চশমা মুছে নিতে হয়৷

না হলে যাবে না দেখা
বুকের বিপণি জুড়ে বন্ধ্যা রমণীরও
ক্রেট-ভরা সাজানো রয়েছে
সম্পূর্ণ নবনীযুক্ত পলিপ্যাক মাদার ডেয়ারি৷

বয়সের বাগান

বয়সের বাগান
--------------------

বাগানের গাছগুলো থেকে পরিচর্যা গুটিয়ে নিয়েছি৷
এখন আর বড় একটা সারে-জলে আদর করি না
গাছেরা যে যার মতো বেড়ে উঠছে তাচ্ছিল্যের হাতে৷
ক্রমশ অসভ্য হচ্ছে শুকনো ডালে, মাকড়সার জালে
তাদের পাতার ফ্রকে লেগে থাকছে নোংরা ধুলো বালি৷

পরিচর্যা উঠিয়ে দিয়েছি৷ এ বয়সে আমি
ওদের ঝামেলা নিয়ে পেরে উঠছি না৷
এখন বাগানে গিয়ে একান্তে দাঁড়ালে
শরীরের খিলানে খিলানে কাঁপে ধ্বস;
জোড়ে জোড়ে শিথিলতা, মাথা চায় হাঁটুর আশ্রয়৷

তবুও আশ্চর্য এই -
এখনও ভাবনার মধ্যে কিছুকিছু ঝোড়োশব্দ পাগলামি করে৷
অনেক অবাধ্য পংক্তি ছুটে যায় কেশর উড়িয়ে -
আমার অস্তিত্ব যেন স্বপ্নে হয় তাদের সওয়ার৷

এখনও বাগানে কিছু অগ্নিবর্ণ অহংকার ফোটে৷

Thursday, May 11, 2006

প্রচ্ছদ

প্রচ্ছদ
======
বানিয়েছি আদ্দির পাঞ্জাবি
বুকে কাজ, কাঁধে কাজ, কুর্তা কলিদার৷
আসলে পাঁজর থেকে পেশীর বাহার
নেমে গেছে বিশ্রীভাবে খাদে৷

ভিতর প্রকোষ্ঠে আদালত
চলছে বিচ্ছেদ মামলা, দুপক্ষই নগ্ন বিপ্রতীপে৷
অথচ বসার ঘরে অভ্যর্থনা, আপ্যায়ন, সরু পরিহাস-
ঘটা করে বিবাহ-বার্ষিকী৷

এই যে উপরে এত শব্দের জমক-
চিত্র-ছন্দ-উপমার অগুরু ও ফুলের চিত্কার-
চাদরের নিচে কিন্তু বোধশূণ্য হলুদ বেদন
নির্বাক কবিতা মরে আছে৷

বানিয়েছি আদ্দির পাঞ্জাবি৷
মেজাজ চড়িয়ে ঘুরি গালে গুঁজে জর্দা-খিলিপান;
পিকের বিদ্রুপ ছুঁড়ি কথায় কথায় -
বলি না গোপন সত্য : পিক দিয়ে ঢাকি রক্তপাত;
পান খাই যক্ষা আছে বলে৷

মানচিত্র

মানচিত্র

কমলেশ পাল
=======
ছেলে আমার ভূগোল পড়ছে :
আমাদের দেশের নাম ... দেশের নাম .... দেশের নাম ....
ভারতবর্ষ ... ভারতবর্ষ ... ভারতবর্ষ ...
ইহার উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা ও দক্ষিণে
ভারত মহাসাগর৷ উত্তরে ... বাবা৷

ডাক শুনে বিলক্ষণ বিরক্ত হলাম৷
মাথায় এক খাবলা তেল মেখে স্নান করছি -
এর পরে গো-গ্রাসে খাওয়া, তারপরে আটটা সাঁইত্রিশের লোকাল ..
...বল্, কি বলছিস্ ...
পর্বতমালা কিরকম বাবা? ....

পর্বতমালা? ও হোলো গিয়ে বড় বড় পাহাড়ের সারি
বিরক্ত করিস না৷ পড়্ ভালো করে পড়্ ....

ছেলে পড়ছে ভারতের চৌহদ্দি
আমি মাথায় জল ঢালছি আর শুনতে পাচ্ছি ...
ভারতের উত্তরে, ভারতের দক্ষিণে ... পূর্বে ... পশ্চিমে ...
চোখের উপর ভেসে উঠছে মানচিত্রের ছায়ারূপ৷
ক্ষুদিরামের, ..... সূর্যসেনের .... লালা লজপতের ...
ভগত্ সিং এর ভারতবর্ষ.... অগনিত মুক্তিযোদ্ধার
ভারতবর্ষ ....ভারতবর্ষের উঠান জুড়ে রক্তের আলপনা ....
মধ্যিকনে জ্বলজ্বল করছে স্বাধীনতার সোনার কলস!

না, আমি কোনো যোদ্ধা নই৷
বিপ্লবী টিপ্লবী ওসব কিচ্ছু নই৷
নিতান্তই গৃহপোষ্য অফিসি কেরানি৷
সকালে বাজার করি৷ দুপুরে অফিস করি৷ সন্ধ্যায় টিউশনি করি৷
রাত্রিতে শয়ন করি৷
আমার গলায় ঝুলছে পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ
দক্ষিণ-বাহুতে মাদুলি, কব্জিতে বাবা তরকেশ্বরের সুতো৷
আমার পিছনে ডাকলে অমঙ্গল
সামনে ডাকলে বিপর্যয়৷
আটটা সাঁইত্রিশের লোকাল আমাকে ধরতে হয় -
আমার তাড়া অছে৷

খোকা বন্ধ কর্ তোর ভূগোল৷
তোর ভূগোলের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে ইতিহাস৷
তুই কি জানিস?
সেই ইতিহসের জীর্ণ পাতা থেকে বেড়িয়ে আসে তিতুমির -
বেরুয়ে আসে বিরসা মুণ্ডার মতো অয়স্কান্ত পুরুষ৷
"কোথায়, কোথায় আমাদের আঁকা সেই ভারতবর্ষের মানচিত্র?
"রাঙা চোখে তাঁরা আমার দিকে তাকায়-
আমাকে এইসব উল্টো পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে৷

আমি দাঁড়িয়েই থাকি৷
আমার চুল বেয়ে, চিবুক বেয়ে, সর্বাঙ্গ গড়িয়ে
ঝরে রড়ছে জল, ঝরে পড়ছে দীন অক্ষমতা৷
কী উত্তর দেব আমি?
হে রাষ্ট, হে চক্র, হে স্ফীতি, হে মোক্ষণ
উত্তরের হিমালয়, দক্ষিণের সাগর বলে দাও
কোনখানে ভারতবর্ষ
কোনখানে পড়ে আছে যুদ্ধেজেতা রক্তের ভারত?
আমি এক ছা-পোষা কেরানি - আহার্যের নিরাপত্তা নেই -
জীবনের নিরাপত্তা নেই - আমাকে এ প্রশ্ন করা কেন?
আমার তো মান নেই, মানচিত্র নেই৷
ছেলে আমার ভূগোল পড়ছে ... দশকোটি মানুষের ঘরে
ছেলে আমার ভূগোল পড়ছে - আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ
ভারতবর্ষ আমাদের দেশ - আঁকা হচ্ছে নতুন মানচিত্র ৷